অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই বাড়ি ফিরছে মানুষ
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় মিতালী মার্কেটে চাকরি করেন ইমরান হোসেন। ঈদের ছুটিতে নিজ গ্রাম কুমিল্লার লাকসাম যাবার উদ্দেশ্যে সাইনবোর্ড মোড়ে বাসস্ট্যান্ডে আসেন তিনি। কাজের সুবাদে নারায়ণগঞ্জ থাকলেও ইমরানের পরিবারের অন্যরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। তবে, পরিবহনগুলো প্রতিবারের মতো এবারও ঈদকে সামনে রেখে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকছে বলে অভিযোগ এ যাত্রীর।
ইমরান বলেন, “হিমাচল পরিবহনে সবসময় যাতায়াত করি। ৪৫০ টাকার ভাড়া এবার চাচ্ছে ৭০০ টাকা। এত ভাড়া চাওয়া তো অনুচিত। যাত্রীদের ঠেকাইয়া যদি ভাড়া নেয় তাহলে তো কিছু করার নাই। দেখি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। নোয়াখালী রুটের কম ভাড়ার কোনো বাস পেলে উঠে পড়বো।”
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। এবার পহেলা বৈশাখও ঈদের পরপর হওয়াতে লম্বা ছুটি পাচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবিরা। ফলে এবারের ঈদের যাত্রা ভিন্ন হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল।
লম্বা ছুটি পাওয়াতে ঈদের একদিন আগেও বাস কাউন্টারগুলোতে টিকেটের জন্য যাত্রী উপস্থিতি ছিল অন্যান্যবারের তুলনায় কম। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার যাত্রীরা অনেকেই আগে চলে গেছেন। কেউ আবার পরিবারের অন্য সদস্যদের আগে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন, নিজেরা যাচ্ছেন শেষ মুহুর্তে। ফলে যাত্রীর চাপ অন্যবারের তুলনায় কম।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১৬টি জেলার মানুষ যাতায়াত করেন। মঙ্গলবার দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মহাসড়ক দু’টিতে বাড়িফেরা যাত্রীবাহী পরিবহনগুলোর আলাদা চাপ দেখা যায়নি।
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও শিমরাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে সিলেট ও চট্টগ্রামমুখী দেশের প্রায় সবগুলো পরিবহনের বাসের কাউন্টার রয়েছে।
কাউন্টারে থাকা পরিবহনগুলোর টিকেট সেলসম্যানদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, গত তিনদিনের তুলনায় ঈদের ছুটিতে গ্রামে ফেরা যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। তবে, শেষমুহুর্তে যে ধরনের যাত্রী চাপ থাকে, এবার তা নেই।
ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেস পরিবহনের শিমরাইল কাউন্টার মাস্টার হাসিবুল হক অন্তর বলেন, “সোমবার বিকেলের আগ পর্যন্ত যাত্রী ছিল নরমাল সময়ের মতো। বিকেলের পর থেকে আজ (মঙ্গলবার) সকাল পর্যন্ত একটা চাপ ছিল। কিন্তু দুপুরের পর থেকে আবার তা কমে এসেছে। সন্ধ্যার পর আবার বাড়তে পারে। কারণ আর তো একদিন আছে।”
মহাসড়কে যানজট না থাকলেও রাজধানীর ভেতরের সড়কগুলোতে যানজট থাকায় নির্ধারিত সময়ে কাউন্টারে বাস আসছে না বলেও জানান পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত শেখ ফরিদ। শিমরাইল স্ট্যান্ডে দোয়েল এক্সপ্রেস ও স্বাধীন ট্রাভেলস নামে দু’টি পরিবহনের মালিকানার সাথে জড়িত থাকা ফরিদ বলেন, “ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা গাড়িগুলো যানজটের কারণে স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে দেরি করছে। তবে মহাসড়কে কোন যানজট নেই। কাউন্টারে বাস চলে আসলে নির্বিঘেœ বাস চলে যাচ্ছে গন্তব্যে।”
সাইনবোর্ড মোড়ে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেতু নামে এক নারী পোশাক শ্রমিক। তার স্বামী বিরতিহীন সিটি সার্ভিস নামে একটি পরিবহনের কাউন্টার থেকে কিশোরগঞ্জের যাওয়ার জন্য দু’টি টিকেট কিনেছেন। তবে, নির্ধারিত সময়ে বাস না আসায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কথা জানান সেতুর স্বামী জুতা প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. মানিকও। তিনি বলেন, “অন্য সময়ে ২০০ টাকা দিয়ে যাই। আজ ১০০ টাকা বেশি রাখলো। বেশি ভাড়া দিয়াও আধঘন্টা যাবৎ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আর দশ মিনিট দেখবো, না পেলে টিকেট ফেরত দিয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে চলে যাবো।”
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জগামী শাহ সুলতান পরিবহনের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, “ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের কাছ থেকে ২০-৫০ টাকা বেশি বকশিস হিসেবে ভাড়া আমরা চাচ্ছি। এইটারে অতিরিক্ত ভাড়া বলা চলে না। তাছাড়া, এইবার তো ঈদের যাত্রী অনেক কম। আমাদেরও তো ঈদ আছে।”
বাসের জন্য পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে কাউন্টারের সামনে মহাসড়কে অপেক্ষা করছিলেন ডেমরার ডগাইর এলাকার ব্যবসায়ী মো. শাহানউদ্দিনও। ৩০ মিনিট যাবৎ অপেক্ষা করলেও কাউন্টার থেকে আরও দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে বলা হচ্ছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
শাহানউদ্দিন বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবো, সোহাগ পরিবহনের বাসের টিকেট কিনেছি। কাউন্টারের লোকজন বলছে, ঢাকার ভিতরে জ্যাম। বাস আসতে পারছে না। কিছু করার নাই, রোদের মধ্যেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে।”
সোহাগ পরিবহনের কাউন্টারে বসা জাকির ভূঁইয়া বলেন, “ঢাকার ভেতরে সায়েদাবাদ, গোলাপবাগ, টিটিপাড়া এলাকায় প্রচুর জ্যাম। যেই বাস ২টা ৪০ মিনিটে আসার কথা তা সাড়ে তিনটায়ও আসেনি। আরও ১৫ মিনিট লাগবে বলতেছে। জ্যাম থাকলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না।”
অধিকাংশ যাত্রী ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করলেও কেউ কেউ আবার বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের মতোই ভাড়ায় টিকেট পেয়েছেন তারা।
তাদের মধ্যে একজন আমিনুল ইসলাম। সেনাকল্যাণ সংস্থায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রূপগঞ্জে জলসিড়ি প্রকল্পে চাকুরিরত এই প্রকৌশলী বলেন, “চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য ইউনিক পরিবহনের টিকেট কিনেছি ৮৫০ টাকায়। অন্য সময়ও একই ভাড়া টিকেট কাটি। এইবার ভাড়া বেশি রাখছে না। তবে চারটায় আসার কথা ছিল তা এসেছে পৌনে পাঁচটায়।”
ভাড়া কম রাখার পেছনে এইবার যাত্রী চাপ কম থাকাকেও কারণ হিসেবে দেখছেন এই যাত্রী।
এদিকে, মহসড়কে যানজট এবং যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ না থাকলেও সাইনবোর্ড ও শিমরাইল মোড়ে মহাসড়কে এলোপাথারিভাবে বাস রেখে যাত্রী তুলতে দেখে গেছে। এতে যান চলাচলে কিছুটা বিঘœ ঘটছে। তবে, মহাসড়কে যান চলাচলের শৃঙ্খলা রাখতে কাজ করতে দেখা গেছে হাইওয়ে পুলিশের সদস্যদের।
শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. শরফুদ্দিন বলেন, “অন্যান্যবারের তুলনায় মহাসড়কে অতিরিক্ত কোনো চাপ নেই। তাছাড়া, ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক বিভাগের সাথে সমন্বয় করে আমরাও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েন আছে। কিছু পরিহহন কাউন্টারের সামনে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তুলছে। কিন্তু তাদের অল্প সময়ের মধ্যে যাত্রী তুলে সড়ক ছেড়ে দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহাসড়কে যাত্রী পরিবহনে শৃঙ্খলায় শেষমুহুর্ত পর্যন্ত কাজ করবে পুলিশ।”