গাজী টায়ারস ট্র্যাজেডি
‘সরকার কী চায় কউক দিমু, আমার পোলার সন্ধানডা দিক’
নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ফারজানা বেগম। সন্তান-সম্ভবা এ নারীর এ সময়ে বাড়িতে বিশ্রামে থাকার কথা। কিন্তু শীতের সকালে নিখোঁজ স্বামীর ছবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার সামনে। সাথে তার ৬ বছরের শিশু সন্তান। গত সাড়ে ৪ মাস ধরে পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।
রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকার বাসিন্দা ফারজানার দাবি, তার কাপড় বিক্রেতা স্বামী মো. ফয়সাল (৩০) গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে নিখোঁজ। ওই রাতে রূপসীর গাজী টায়ারস কারখানায় আগুনের ঘটনার পর ভাতিজাকে খুঁজতে কারখানার ভেতর ঢোকেন তিনি। ভাতিজা বাড়ি ফিরলেও কোনো খোঁজ নেই ফয়সালের।
ফারজানার মতো পরিস্থিতি এ উপজেলার শতাধিক পরিবারের। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে বুধবার (৮ জানুয়ারি) সকালে রূপগঞ্জ থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন তাদের স্বজনরা। বিক্ষোভরত স্বজনরা থানা ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। পরে তারা থানা ফটকে অবস্থান নেন। পুলিশের পক্ষ থেকে স্বজনদের আশ্বস্ত করা হলে দুপুর দুইটার দিকে তারা থানা ফটক ছাড়েন।
এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা।
সকালে থানার সামনে কথা হয় নিখোঁজ আমানউল্লাহ’র বৃদ্ধা মা রাশিদা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ-প্রশাসন খালি তালিকা করে। তালিকা কইরা কাগজ ড্রয়ারে থুইয়া দেয়। আমার পোলার তো কোনো খোঁজ দেয় না। সরকার কী চায় আমাগোরতে, কউক, তাই দিমু। কিন্তু আমার পোলার সন্ধানডা দিক। তাগো মইধ্যেই ঘাপলা আছে, নাইলে কিছু কয় না কেন!’
শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৫ অগাস্ট যানবাহনের চাকার টায়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ারসে লুটপাটের পর আগুন দেয় কিছু লোক। টানা পাঁচ দিন ধরে আগুন জ্বলে এ কারখানায়।
কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ অগ্নিকাণ্ডে ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে উপজেলার ছাতিয়ান এলাকার বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি হাসান আলীর নাম। স্বামীর সন্ধান না পেয়ে দিশেহারা শান্তা বেগম। সাড়ে তিন বছরের ছেলের ভবিষ্যত নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে তার।
‘কারও কাছে কোনো টাকা-পয়সা চাই না। হ্যায় (হাসান) যদি আগুনে পুইড়া মইরা গিয়া থাকে তাইলে হাড্ডি দিবো, নাইলে ছাই দিবো। নাইলে অন্তত কইবো তো যে, হ্যায় মারা গেছে। কিন্তু কিছ্ইু তো কয় না কেউ। শিশু একটা বাচ্চা রাইখা তার বাবায় চইলা গেছে। আমার দুঃখ বোঝার মতো কেউ নাই।’
কথা হয় নিখোঁজ সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক মুন্নার মা নূর বেগম, স্টিল মিলের শ্রমিক ফয়েজ আহমেদের মা মনোয়ারা বেগম, মিস্ত্রি শাহীনের মা শাহানা, ফল বিক্রেতা সুমনের মা গোলেনূর বেগম, সজীবের মা কুলসুম বেগমের সাথে। তারাও তাদের পরিবারের সদস্যদের সন্ধান দাবিতে থানার সামনে অবস্থান নেন।
কুলসুম বলেন, ‘এসপি, ডিসি, ওসি; সবার কাছে গেছি। সবাই কয়, আজকা না কালকা ফিররা আইবো। খালি ধৈর্য ধরতে কয়। ফিইররা আহোনের হইলে তো আগেই আইতো। যার সন্তান হারায় সেই কেবল বোঝে সন্তান হারানোর দুঃখ।’
স্বজনরা আরও বলেন, আগুনের ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজদের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি সরকারি কোনো সংস্থা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলছে না প্রশাসনের লোকজন। কারখানার ভেতরে দেহাবশেষ কিছু আছে কি-না সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান চালানো হয়নি।
নিখোঁজদের সন্ধান দিতে প্রশাসন অবহেলা করছে বলেও অভিযোগ করেন স্বজনরা।
যদিও রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিখোঁজদের একটি তালিকা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাইয়ের পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা ধরে কাজ করছে পুলিশ। নিখোঁজদের স্বপক্ষে তথ্য যাচাই করছি। তাদের ব্যাপারে ডাটাগুলো কালেক্ট করছি। তবে, এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’