জাকির খানের মুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানসহ সকল আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত।মঙ্গলবার বেলা সোয়া এগারোটার দিকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মমিনুল ইসলাম। মামলার কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছানোর পর তার মুক্তির আর কোনো বাধা থাকবে না বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী রাজীব মন্ডল।
তিনি বলেন, “জাকির খানের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা ছিল। ৩০টি মামলায় ইতোমধ্যে তিনি খালাস পেয়েছেন। আজ আরও একটি হত্যা মামলায় তিনি খালাস পেলেন। দু’টি চাঁদাবাজি ও অস্ত্র মামলা এখনও তার বিরুদ্ধে চলমান। কিন্তু ওই দুই মামলাতেও তিনি জামিনে রয়েছেন। মামলার কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছানোর পর তার মুক্তির আর কোনো বাধা থাকবে না।”
এ মামলায় খালাস পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন- জাকির খানের দুই ছোটভাই জিকু খান ও মামুন খান, তার সহযোগী জঙ্গল ওরফে লিটন, মোক্তার হোসেন, মনিরুজ্জামান শাহীন, নাজির আহমেদ ও আব্দুল আজিজ। এদের মধ্যে মনিরুজ্জামান শাহীন মারা গেছেন।
২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর মাসদাইর এলাকায় নিজের বাড়ির অদূরে সাব্বির আলম খন্দকারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিট পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সাবেক সহসভাপতি সাব্বির বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা (বহিষ্কৃত) ও বর্তমানে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের ছোটভাই।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, এই মামলায় ৫২ জন সাক্ষীকে তালিকাভুক্ত করা হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে ২১ জনের। দীর্ঘ সময়ে এ মামলাটি তদন্ত করেছেন অন্তত ৯ জন কর্মকর্তা।
মামলার নথিসূত্রে জানা যায়, সকালে প্রাতর্ভ্রমণের জন্য নগরীর মাসদাইর এলাকার শেরে বাংলা সড়কের বাসা থেকে বের হন ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার। বাসার অদূরে সড়কের উপর স্থানীয় দু’জন ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময় আততায়ীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় তার বড়ভাই আলোচিত রাজনীতিক তৈমুর আলম খন্দকার ফতুল্লা মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলায় তিনি তার ভাইয়ের হত্যার জন্য ওই সময়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করেন। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে জাকির খান ও তার দুইভাইসহ আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
অভিযোগপত্রে গিয়াসউদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়ায় নারাজি দিলে আদালত পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। যদিও ২০১১ সালে মামলার বাদী তৈমুর তার নারাজি পিটিশন প্রত্যাহারের আবেদন করলে সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্র অনুযায়ী মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয়। তবে এর কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে।
এ মামলার অভিযোগপত্রে অভিযুক্তের তালিকায় তিন নম্বরে ছিলেন জাকির খান। উপরের তালিকায় ছিল তার দুই ছোটভাইয়ের নাম। ছাব্বির আলম হত্যা মামলা ছাড়াও জাকির খান আরও অন্তত তিনটি হত্যা এবং অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ ২৯টি মামলায় অভিযুক্ত। বেশ কয়েকটি মামলায় ইতোমধ্যে তিনি বেকসুর খালাস ও জামিন পেয়েছেন।
এদিকে, দীর্ঘ বছর পলাতক থাকার পর ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর র্যাব-১১ এর এক অভিযানে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন জাকির খান। তার গ্রেপ্তারের পর ছাব্বির আলম হত্যা মামলার বিচারকাজ গতি পায়। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে সাক্ষ্য দেন এই মামলার বাদী তৈমুর আলম খন্দকার।
এদিকে, গতবছর আসামিপক্ষের আইনজীবীর এক আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেন বলে জানান জাকির খানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাজীব মন্ডল।
নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে আসা জাকির হোসেন ওরফে জাকির খান একসময় শহরের ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার পর আসামি হিসেবে নাম এলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
প্রায় দুই দশক পর আগ্নেয়াস্ত্রসহ তাকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, সাব্বির হত্যা মামলার পর জাকির থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। পলাতক থাকা অবস্থাতেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় আদালত সাজা প্রদান করে। এরপর থেকে তিনি আর দেশে ফেরেননি। এক বছর আগে ভারত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
জাকিরের নামে চারটি হত্যা মামলাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে উল্লেখ করে র্যাব জানায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী ও মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন জাকির খান। দেওভোগ এলাকার অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে শহরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী।
“জাকির খানের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন বিশেষ আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় তার ১৭ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে তার সাজা কমে আট বছর হলেও তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে দেশে ও বিদেশে প্রায় দুই দশক পলাতক ছিলেন।”
জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য একেএম নাসিম ওসমানের হাত ধরে জাকির জাতীয় ছাত্র সমাজে যোগ দেন। ওই নেতার সঙ্গে বিরোধের জেরে ১৯৯৪ সালে তিনি ছাত্রদলে যোগ দেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জাকির জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। তখন শহরের ডিআইটিতে তাকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক দফা জেলও খাটেন তিনি। দেশে না থাকলেও অনুসারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল জাকির খানের।
গত ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শহরের পরিবহন, ঝুটসহ বিভিন্ন সেক্টরে জাকির খানের অনুসারীদের দখল ও আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি পরিবহন দখলকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে জাকির খানের অনুসারীদের সাথে বিএনপির আরেকটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এই সময় গুলিও চলে।