১৯ এপ্রিল ২০২৫

সিফাত হাছান সুমাইয়া

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

বটতলার মেলা, শৈশবের স্মৃতি ও আজকের পহেলা বৈশাখ

বটতলার মেলা, শৈশবের স্মৃতি ও আজকের পহেলা বৈশাখ

বাংলা ১৪৩২ সালের প্রথম সকালে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করে। স্মৃতির ঝাঁপি খুলতেই চোখে ভেসে ওঠে ১৪-১৫ বছর আগের কোনো এক পহেলা বৈশাখের ছবি—যেখানে বটতলায় বসত মেলা, আর মেলা মানেই ছিল আনন্দ, উৎসব আর মানুষের মিলনমেলা।

বৈশাখ এলে তখনকার ছেলেমেয়েদের একটাই ভাবনা—কখন মেলায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে, কী কী কিনবে। এই মেলা শুধুই কেনাকাটা কিংবা প্রদর্শনী ছিল না, বরং গ্রামীণ জীবনের প্রাণবন্ত একটা অংশ, এক সামাজিক উৎসব। গ্রামের প্রতিটি মানুষ মেলার দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকত। মেলা যেন একদিনের জন্য হলেও গ্রামকে বদলে দিত। চারদিক কোলাহলে মুখর, উত্তেজনায় টগবগ করত সবার মন।

ছোটবেলায় প্রতিটি বৈশাখে দল বেঁধে মেলায় যাওয়া ছিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। কখনও পরিবারের সবাই মিলে, কখনও প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়দের সঙ্গে। কী খাব, কী কিনব, কোন স্টলে আগে যাব—এসব নিয়ে পরিকল্পনার শেষ থাকত না। মেলায় গিয়ে কখনও এক টুকরো মিষ্টি, কখনও একজোড়া কাচের চুড়ি কিংবা রঙিন বেলুন—সবকিছুতেই লুকিয়ে ছিল অনাবিল আনন্দ।

খাবারের স্টলে পাওয়া যেত পাটিসাপটা, নারিকেলের নাড়ু, খেজুরের রস, মুড়ি-মুড়কি কিংবা পাকা আমের আচার। সে স্বাদ আজকের শহুরে রেস্টুরেন্টের বিলাসী খাবারের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়, অনেক বেশি হৃদয়ের।

তবে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল মানুষের পারস্পরিক মিলন। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা, বন্ধুরা একসঙ্গে মেলায় ঘোরা, হাসি-ঠাট্টায় মুখর আড্ডা—এসব মিলেই মেলা হয়ে উঠত জীবনের অংশ।

কিন্তু সময় বদলেছে। বদলে গেছে মানুষের জীবনধারা, উৎসব পালনের ধরণও। শহরের চকচকে আয়োজন, ডিজিটাল মাধ্যমের প্রচার-প্রসার, ব্যস্ত জীবন—সব মিলিয়ে সেই আগের বৈশাখ আর মেলার রূপ এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো এখন অনেকটাই নিষ্প্রাণ।

আজকাল গ্রামের মেলাতেও আগের মতো সেই প্রাণ নেই। ছোটদের দলবেঁধে ঘোরা নেই, নেই সেই পারিবারিক উচ্ছ্বাস। বরং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ছবি বা ভিডিওই যেন অনেকের কাছে উৎসবের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু বাস্তবের সেই ছোঁয়া, অনুভব, সম্পর্কের উষ্ণতা আর দেখা যায় না।

আমাদের ছোটবেলার বৈশাখ আর বটতলার মেলার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে মোবাইল স্ক্রিন। আমরা একে অপরকে উপলব্ধির বদলে এখন দেখি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা ইউটিউবের ফ্রেমে। অথচ এক সময় এই মেলাই ছিল যোগাযোগের একমাত্র সুযোগ, হৃদয়ের বাঁধন দৃঢ় করার উপলক্ষ।

তবু এখনও কিছু কিছু গ্রাম, কিছু মানুষ, কিছু আয়োজন আছে—যারা এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তারা জানেন, শিকড়কে ভুলে গেলে গাছ টেকে না। তারা বারবার মনে করিয়ে দেন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানবিক সম্পর্কের বন্ধন হারানো উচিত নয়।

আধুনিকতার দৌড়ে চলা এই সময়েও তাই যখন বৈশাখ আসে, স্মৃতির বটতলা মেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা কোথা থেকে এসেছি। স্মৃতি হয়তো ফিরিয়ে আনা যায় না, কিন্তু তা হৃদয়ে ধারণ করে ঐতিহ্যকে ধরে রাখা যায়। আর সেটিই হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের উপহার।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়