০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রফিউর রাব্বি

প্রকাশিত: ১৬:০৫, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য

এ মাসেই প্রকাশিত হচ্ছে “নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য” গ্রন্থ। গ্রন্থে ১২টি অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে: ১. ঐতিহাসিক পটভূমি, ২. প্রশাসনিক নারায়ণগঞ্জ, ৩. জাতি গঠন ও সংস্কৃতির রূপান্তর, ৪. সাহিত্য, ৫. নাটক, ৬. চলচ্চিত্র, ৭. চিত্রকলা, ৮. সংগীত, ৯. সংগঠন, ১০. সংগ্রাম (ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ’৬৯, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান ’৯০, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ’২৪), ১১. প্রত্নসম্পদ, প্রাচীন স্থাপত্য ও উল্লেখযোগ্য স্থান, ১২. শিল্প-বাণিজ্য। 

একটি জনপদের ইতিহাস হলো, সে অঞ্চলের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং সেখানকার মানুষের যাপিত জীবনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। অর্থাৎ, সে অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতাই সেই অঞ্চলের ইতিহাস। অন্যভাবে বললে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, চিন্তা, রুচি, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাই সে সমাজের ইতিহাস।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নতুন যে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি হয়, তা-ই সংস্কৃতির বুনিয়াদ।

যদিও বঙ্গীয় বদ্বীপের সংস্কৃতিতে এ অঞ্চলের নদী, জলবায়ু, ভূমি ও প্রকৃতির গভীর প্রভাবের কারণে এখানে এক অনবদ্য ঐক্যতান বিদ্যমান, তারপরও অঞ্চলভেদে সংস্কৃতিতে তৈরি হয়েছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। আর তাই নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্য অঞ্চল থেকে আলাদা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকা দখল করে একে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নামকরণের মাধ্যমে রাজধানী করার পর থেকে ঢাকা শহরের সূচনা বলে মনে করা হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, কত্রাবো ও খিজিরপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল ঢাকা রাজধানী হওয়ার কয়েকশ বছর আগে থেকেই রাজধানী হওয়ার সুবাদে যে নারায়ণগঞ্জ ঢাকার চেয়েও প্রাচীন, তা বহু ইতিহাসবিদের বর্ণনায় উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তা কত বছর পুরোনো তা সুনির্দিষ্টভাবে এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। তবে উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নখননের পর জানা যায়, এই জনপদ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো।

১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজি বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে, তিনি রাজ্য শাসনের সুবিধার্থে বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে সোনারগাঁকে পূর্ব বাংলার রাজধানী করেন। তাঁর শাসনামলেই সোনারগাঁ পূর্ব বাংলার রাজধানী হয়। পরে তিন শতাব্দী পর্যন্ত সোনারগাঁ বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা (কুমিল্লা), চট্টগ্রাম এবং শ্রীহট্ট (সিলেট) সোনারগাঁ রাজধানীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে সোনারগাঁ অন্যান্য অঞ্চল থেকে এগিয়ে ছিল।

কৌটিল্য (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক) তার অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের একাদশ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের তৈরি দুকুল (সূক্ষ্ম বস্ত্র) শুভ্র ও মসৃণ। সুতরাং বঙ্গের সংস্কৃতি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকেও বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ আড়াই হাজার বছর আগে বঙ্গের যে খ্যাতি, তা মূলত সূক্ষ্ম বস্ত্র (মসলিন) কেন্দ্র করে, আর উন্নত মসলিন তৈরির কার্পাস উৎপন্ন হতো সোনারগাঁয়ে। তুলা বা কার্পাস উৎপাদনের জন্য শ্রেষ্ঠ অঞ্চল ছিল সোনারগাঁ।

ঐতিহাসিক স্বরূপ চন্দ্র রায় তাঁর সুবর্ণ গ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মহাভারতের ভীম ‘লাঙ্গল বন্দে’ এসেছিলেন।’ লাঙ্গল অস্ট্রিক শব্দ। সুতরাং শব্দটি আর্যপূর্ব যুগের। অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভারতে এসেছিলেন। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাভারতকে প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয়ে এই গ্রন্থের ‘নারায়ণগঞ্জ’ অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোকপাত করা হয়েছে।

অন্যান্য জেলায় ইতিহাস সংবলিত কমবেশি কাজ হলেও নারায়ণগঞ্জে তেমন কাজ হয়নি। কিন্তু এটি একটি জেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রশ্ন থাকলেও সুধীজন পাঠাগার থেকে প্রকাশিত ‘নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থটি এখানে এখনো একমাত্র তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য। সৈকত আসগর এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য নিয়ে কিছু কাজ করেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো ইতিহাসই কখনো পুরো জনগোষ্ঠীর কাছে সমাদৃত হয় না। ইতিহাস থাকে বিজয়ীদের পক্ষে, পরাজিতরা তা সহজে গ্রহণ করতে পারে না। আবার এটি সত্য যে, মনের মাধুরীতে ইতিহাস হয় না। নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ইতিহাসের সত্যতা নির্ভর করে। এ গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যাদির উৎস স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইতিহাসে নিজের কথা বা মতামত নয়, নির্মোহতা গুরুত্বপূর্ণ। তবু বলতে হয়, ইতিহাস একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংগৃহীত নতুন তথ্য পুরোনোকে খারিজ করে নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারে। আবার ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই মানুষ তার ভবিষ্যৎ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলে। “নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য” গ্রন্থটি বর্তমান ও আগামীর মানুষকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে এবং শিকড় বা উৎসের দিকে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়