প্রেমিক প্রেমিকা ধরার অভিযান ও শিকারি সাংবাদিকতা
বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ হইলো “বাটে পড়া” দের জন্য। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন স্তরে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার ভুরি ভুরি ঘটনা আছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল, যাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে বাটে ফেলা যায়। তাদের উপর বিভিন্ন সংস্থা চেপে বসে আইন প্রয়োগ করে।
কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক সন্ধ্যায় নিজ এলাকায় বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমাদের সামনে দিয়ে দুজন কলেজ ড্রেস পড়ুয়া দুই তরুণ তরুনী হাত ধরে হেটে যাচ্ছিলো। আমার সাথে থাকা বন্ধুটি এই চিত্র দেখে তেলে বেগুনে ক্ষিপ্ত হলো। ‘এলাকার ভেতর হাত ধরে যাচ্ছে, এত বড় দুঃসাহস! এখনই ধরে কট দিতে হবে।’ সাথে দুজন নিয়ে সামনে এগোতেই বিপত্তি, কারন পথ আটকেছি আমি।
প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম- আমাদের সামনে যখন মাদক বিক্রি করে, মাদক খায়, তাদের আটকাতে গেছিলা কোনদিন? যদি না যাও তাইলে এদের কিছু করার স্পর্ধা দেখাইয়ো না। এরা দেশের কোন আইন অমান্য করে নাই। জোরপূর্বক ধর্মের পথে আনার দায়িত্ব তোমারে দেয়া হয়নাই। বাঁধা পেয়ে আমাকে কয়েকবার নাস্তিক বলে গালাগাল দিয়ে গজগজ করতে লাগলো। তাতে অবশ্য আমার কিছু আসে যায়নি।
সম্প্রতি আড়াইহাজারে উঠতি বয়সী তরুণ তরুনীরা রেস্তোরাঁয় প্রেম করার অপরাধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকঢোল পিটিয়ে সাথে তাদের আটক করেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দক্ষতার সাথে তাদের জনগনের সামনে কালপ্রিট হিসেবে উপস্থাপন করে অতঃপর পরিবারের হাতে সোপর্দ করেছেন। নিয়েছেন মুচলেকাও।
ততক্ষণে উৎসুক জনতা ও এক শ্রেনীর মোরাল পুলিশিং এ নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ তাদের ছবি, ভিডিও তুলে ভাইরাল করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ একত্রিত হয়ে আড্ডা দেয়ার মত গর্হিত অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে পেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন তারা।
এই উৎসুকরাই পার্কে দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে একত্রে দেখলে বাটে ফেলে বলবে - তোরা চার দেয়ালের ভেতর কেন যাস না? আবার চার দেয়ালের ভেতরে গেলে বাটে ফেলে বলবে - বিয়ে ছাড়া এলি কেন? আবার বিয়ে করার পর বউ নিয়ে ঘুরতে বের হলে বাটে ফেলে বলবে – কাবিননামা কই? কিন্তু আপনি যদি প্রভাবশালী, অর্থশালী হন। কিংবা বান্ধবীকে নিয়ে তারকামানের রেস্তোরাঁয় বসেন। সেখানে আপনার উপর আইন প্রয়োগ করা বেশ কঠিন, কখনও কখনও তা অসম্ভবও বটে।
বর্তমান সমাজে সাধারণ মানুষের জন্য আতংকের আরেক নাম শিকারি সাংবাদিকতা। ধরুন কোন এক ফেইসবুক সাংবাদিক জীবনে প্রেম করতে পারেনি। উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের প্রেম ভালোবাসা দেখলে গাঁ জ্বালা করে। তাদের সামনে এই ধরণের ঘটনা পড়লে অত্যান্ত রসবোধের সাথে সেসব ছবি, ভিডিও প্রচার করেন। ভিউ এর নেশায় লিখেন চমকপ্রদ শিরোনাম। তাতে সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা থাকলো কি না থাকলো সেসব দেখার বালাই নেই।
ফলাফল হিসেবে দাঁড়ায়, সাংবাদিক আগে ছিলো ভরসার নাম। সর্বত্র অনিরাপত্তায় ভুগে মানুষ দ্বারস্থ হতো সাংবাদিকের কাছে। এখন শিকারি সাংবাদিকতার কারনে ভুক্তভোগী হওয়া মানুষরা সংবাদকর্মীদের ঘৃণার চোখে দেখে।
সাবিত আল হাসান, গণমাধ্যমকর্মী