ত্বকী: গানের সমাপ্তি নেই
ত্বকীর মতো কিশোর একটি সমাজে বেড়ে উঠা তার জীবনের লক্ষণ; ত্বকীর মতো মানুষ, একজন সজাগ কিশোর, নিজের থেকে বের হয়ে সর্বজনের সাথে যখন নিজেকে যুক্ত করে তখন সমাজের প্রাণেও নতুন স্পন্দন যোগ হয়। মানব ইতিহাসের বিভিন্নকালে সর্বজনের এই প্রাণকে স্তব্ধ করে দেয়ার অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু এসব বর্বরতার বিরুদ্ধে সমাজ কতটা রুখে দাঁড়াতে পারে তার উপরই নির্ভর করে সমাজে আরও ত্বকীর জন্ম হবে কিনা, সমাজ নিজেকে জীবন্ত রাখতে সক্ষম কিনা।
বৈষম্য আর নিপীড়নের রাষ্ট্র ত্বকীদের সহ্য করতে পারেনা। তার দরকার প্রাণহীন রোবট কিংবা অনুগত দুর্বৃত্ত, সহযোগী বাহিনী। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাই ত্বকীর খুনিদের রক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কোথায় সক্রিয় কোথায় নিষ্ক্রিয় তা নির্ধারিত হয় তার অবস্থান দিয়েই। ত্বকীকে যারা হত্যা করেছে তারা দেশ জুড়ে আছে। নদী দখল, নদী দূষণ, বন উজাড়, বায়ু দূষণ, ব্যাংকলুট, চাঁদাবাজী, ক্রসফায়ার সবকিছুর যারা হর্তাকর্তা তাদের মধ্যেই ত্বকীর খুনিদের প্রতিকৃতি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্র পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেই এদেরকে রক্ষা করে। ত্বকী হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তদন্ত হয়েছে, প্রমাণাদি সংগৃহীত হয়েছে, আলামতসহ সব কিছু থেকে সনাক্ত হয়েছে খুনি কারা। সনাক্ত হবার পরই নির্দেশ এসেছে সব কিছু পাথরচাপা দেবার। সেই পাথর আজও সরেনি। সাগর-রুনী, তনুসহ এরকম আরও অনেক হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও ঘটনাবলী এইরকম। সূত্রটি খুব সরল: অপরাধী যদি সনাক্ত হয় এবং সে যদি ক্ষমতাবানদের সহযোগী হয় রাষ্ট্র তখন গভীর নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে তাকে রক্ষা করে।
প্রকৃতপক্ষে এক চরম বৈপরীত্য কিংবা কপটতার মধ্যে আমরা সময় পার করছি। একদিকে শাসক-ক্ষমতাবান-বিত্তবান গোষ্ঠীর সকল শাখা অবিরাম দেশপ্রেম-এর ঢোল বাজাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠীর মুনাফার রাস্তা তৈরী করতে দেশের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ মানুষকে বিপন্ন/বিপর্যস্ত /ক্ষতবিক্ষত করে যাচ্ছে। তারা একদিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গিয়ে চোখ-নাক দিয়ে পানি ফেলতে থাকে, অন্যদিকে এই গানে বিবৃত আমের ছায়া, বটের ছায়া , নদীর কূল, মায়ের মুখের ওপর মুনাফার আগ্রাসন চালাতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। নদী-বন-খোলা জায়গা অবাধে খেয়ে যেতে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করতে মানুষের হাত-পা-মুখ-চোখ বেঁধে রাখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। একদিকে শুনি ‘সন্ত্রাস দমন’ আর ‘দুর্নীতি দমন’-এর গান অবিরাম, অন্যদিকে দেখি বৃহৎ দুর্নীতিবাজ আর সন্ত্রাসীদের অবাধ রাজত্ব।
তাই সন্ত্রাস, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের দিন কাটে। এর সাথে সাথে আমাদের অসহায়ত্বের বোধ যখন যোগ হয় তখন তা আমাদের আরও ভয়াবহ জগতে ঠেলে দেয়। একটি সমাজে অন্যায়, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বৈষম্য থাকতেই পারে; কিন্তু তা কতদিন, কতদূর যেতে পারে? এরকম পরিস্থিতি চিরস্থায়ী নয় তার পরিবর্তন সম্ভব এই বোধ মানুষের মধ্যে যদি জীবন্ত থাকে তাহলে মানুষও জীবন্ত থাকে। কিন্তু যদি সমাজে এরকম ধারণা তৈরি হয় যে, যা কিছু চলছে তার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয় তাহলে পুরো সমাজেই নেমে আসে অসারতা। তখন ভোগবিলাস শানশওকত যতোই দেখা যাক না কেন সেই সমাজকে আর তার মানুষকে আর জীবন্ত বলা যায় না।
বর্তমান সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনায় যেভাবে ন্যায়-অন্যায়, বিচার- অবিচার, উন্নয়ন আর ধ্বংস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর তার উল্টো যাত্রা একাকার করে দিয়েছে তার পূর্ব দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন। কথায় ‘অপরাধী যেই হোক তাকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে’, কাজে ‘অপরাধী যদি আমাদের লোক হয় তাহলে যে কোনো মূল্যে তাকে রক্ষা করা হবে।’ কথায় ‘নদী দূষণ দখল মেনে নেয়া হবেনা, তার সঙ্গে জড়িত যেই হোক তার বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ আর কাজে ‘আমাদের লোকদের বিরুদ্ধে নদী দখল দূষণ এসব অভিযোগ তুললে খবর আছে।’ কথায় ‘বন কৃষি জমির ক্ষতি করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হবে না।’ কাজে ‘আমাদের প্রকল্প নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। বন কৃষিজমির যাই হোক তা আমরা দেখবো।’ কথায় ‘আমরা কারও কাছে মাথা নত করিনা।’ কাজে ‘ক্ষমতার থাকার জন্য ভারত চীন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র যা চায় তার থেকে বেশি দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’ কথায় ‘আমরা সুন্দরবন রক্ষা করতে সবকিছু করবো।’ কাজে ‘সুন্দরবন ধ্বংস হলেও ভারতের রামপাল আর দেশি ভাগীদারদের প্রকল্প অবশ্যই চলবে।’ কথায় ‘আমাদের কাছে দুর্নীতিবাজ খুনি সন্ত্রাসীদের কোনো জায়গা নেই।’ কাজে ‘যারা যতদিন আমাদের কাজে লাগবে ততদিন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গ্রহণ করা হবে না।’....
‘উন্নয়ন’ নামে প্রাণ-প্রকৃতি-বৈচিত্র-ভবিষ্যৎ বিনাশী উন্মাদনার মধ্যে বাস করছি আমরা। বাংলাদেশের নদী পানি বন পাহাড় সর্বোপরি মানুষ সবই তথাকথিত উন্নয়নের নখরাঘাতে বিপর্যস্ত। বায়ু দূষণে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে বাংলাদেশ, পরিবেশ বিপর্যয়ে বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। এর মধ্যে আরও বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে যেগুলো থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর লাভ হলেও দেশের মানুষ তো বটেই সর্বপ্রাণ এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও ভয়ংকর হুমকি হবে। প্রাণ বৈচিত্র, জাতি বৈচিত্র, ধর্ম বৈচিত্র, ভাষা বৈচিত্র, বিশ্বাস বৈচিত্র সবকিছুই অন্ধ ‘উন্নয়ন’, মুনাফার দাপট আর স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রনীতির শিকার। এসব থেকে মুক্তির স্বপ্নই ত্বকীকে চালিত করেছে। ত্বকীকে তাই স্তব্ধ করতে চেয়েছে দানবেরা।
ভয়, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তা সারাক্ষণ ঘিরে থাকলেও মানুষ তার নিজেকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে নদী, বন, বাতাস, পাহাড়, মর্যাদা, দেশ রক্ষার পথ খোঁজে। এই পথ সন্ধান পথে, মিছিলে, গানে, প্রাণে, স্বপ্নে অবিরাম চলছে; বারবার মার খেয়েও যারা বারবার উঠে দাঁড়ায় নতুন জীবনীশক্তি নিয়ে।
এই লড়াই তো শুধু বাংলাদেশের নয়। এখানে বিশ্বের আরেক প্রান্তের মানুষের লড়াইএর কথা বলে শেষ করি। ১৯৭৩ সালে চিলিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে সিআইএ-সেনাবাহিনী জোট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের পর সেদেশে শুরু হয় বহুবছরের স্বৈরশাসন, নির্যাতন, গুম, খুনের ভয়ংকর অধ্যায়। ১১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যার পর সান্টিয়াগো স্টেডিয়ামে আটক হাজার হাজার তরুণের মধ্যে ছিলেন ভিক্টর জারা, চিলির খুবই জনপ্রিয় গীতিকার কবি। মেরে তাঁর হাত ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর গান থামেনি। একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করে জেনারেল পিনোচেট-এর দানব বাহিনী।
মৃত্যুর আগে জারার লেখা শেষ কবিতা পরে উদ্ধার হয়। মৃত্যুর মুখে জখম রক্তাক্ত শরীরে তিনি যে কবিতা লেখেন তার প্রতিধ্বনি কিশোর ত্বকীর কলমেও আছে। জারা লিখেছেন:
‘ফ্যাসিবাদের বাহিনী কী ভয়াবহতা সৃষ্টি করতে থাকে
ছুরির মতো কী সুক্ষ্ম নিপুণতায় ভয়ংকর কাজগুলো করে যায়...
তাদের কাছে আরও রক্ত মানে আরও মেডেল...
কী কঠিন আমাদের গান গাওয়া
কিন্তু এই ভয়াবহতার গান আমাদের গাইতেই হবে
কেননা নীরবতা আর গোঙানি মানে
গানেরই সমাপ্তি...’
খুনি দানবদের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইএ জীবন্ত মানুষের সাহস দিয়ে যারা এই জনপদে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন ত্বকী তাঁদের একজন। অমর।
আনু মুহাম্মদ: লেখক, অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।