০৩ নভেম্বর ২০২৪

রফিউর রাব্বি 

প্রকাশিত: ২১:০৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ২১:২৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

৪০ বছরে অন্য এক চুনকা

৪০ বছরে অন্য এক চুনকা

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর ‘ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু কখনোই হারবে না।’ বস্তুত মানুষ কখনোই পরাজিত হয় না। মৃত্যুও মানুষকে পরাজিত করতে পারে না বরং জীবনে পূর্ণতা নিয়ে আসে। মৃত্যু মৃত্যুকে অতিক্রম করে নিয়ে যায় অন্তহীন এক জীবনের পথে। আমাদের সাংস্কৃতিক জোটের এক সেমিনারে সরদার ফজলুল করিম একবার বলেছিলেন, ‘মানুষ মরণশীল বটে কিন্তু মানুষ মরে না।’ এ হচ্ছে বিশ্বাস ও সত্যের ব্যাপার, উপলব্ধির ব্যাপার। আমরা প্রত্যেকেই বস্তুকে যা দেখি প্রকৃত অর্থে প্রকৃতি ও বস্তু হুবহু তা নয়। এখানে আমাদের বোধ ও উপলব্ধি কাজ করে। দেখার সাথে তা মিশে যায়। ঠিক একইভাবে একজন মানুষকে আমরা যে রকম দেখি প্রকৃত অর্থে তিনি হুবহু সে রকম নন। আমাদের দেখাটা কোন পর্যবেক্ষণ নয়, বিশ্লেষণ নয়। তারপরেও সময়, সমাজ ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এ দেখাটা বদলে যায়, ভিন্ন ভিন্ন হয়। একটা মানুষকে মূল্যায়ণের জন্য নির্দিষ্ট একটা সময় অতিক্রম করাটা জরুরি। নির্মোহ মূল্যায়ণে নির্দিষ্ট একটা বিতির প্রয়োজন পরে। নির্মোহ ইতিহাসের বিশ্লেষণে যেমনি অন্তত অর্ধশতাব্দি বিরতিটি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয় বিষয়টি ঠিক তেমনি। আলী আহম্মদ চুনকার বিরতিটি ৪০ বছর। ১৯৮৪তে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

তাঁর জীবনের পরিধি প্রায় অর্ধশতাব্দির। পুরো পঞ্চাশ বছরও নয়। ১৯৩৪-এর ১৬ ডিসেম্বর আগমন আর ১৯৮৪-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্থান। কাকতালীয় হলেও সত্য তাঁর আগমনের ৩৭ বছর পরে তাঁর জন্মের দিনটি গোটা জাতির তথা বিশ্বেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সাথে যেন তাঁর জন্মের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

আলী আহম্মদ চুনকা প্রচলিত ধারার বাইরে গড়ে ওঠা একজন মানুষ। জীবনকে উপভোগ করার প্রথাগত ধারণা তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি। বৃত্তের বাইরে গড়ে ওঠা কদাচিৎ যে কিছু জীবনের সন্ধান আমরা পাই যা ঝলসে ওঠে বিদ্যুতের মতো আর জানান দেয় পরিবর্তনের; তিনি তেমনি এক পরিবর্তিত জীবনের বার্তাবাহী। তাঁর শিক্ষক মূলত মানুষ ও প্রকৃতি। আর তাই শিক্ষা নিখাদ। মানুষ ও প্রকৃতিকে সকলেই পাঠ করতে পারেন না, সকলেই এর ভাষা বোঝেন না। যারা পারেন বা বোঝেন কেবল তারাই এর সাথে মিশে যেতে পারেন; মানুষের সাথে মিশে মানুষ হয়ে ওঠেন। তার মধ্যে গড়ে ওঠে এক ধরনের দায়বোধ, এক ধরনের কর্তব্যপরায়ণতা। নেতা-নেত্রীদের সাহচর্য, জৌলুসে জীবনের বাইরে চা-পানের দোকানের সাধারণ মানুষের সঙ্গ বড় বেশি আকর্ষণ করেছে তাঁকে। জীবনের সত্যটি উপলব্ধির যোগ্য জায়গাটি নির্বাচনে তিনি ছিলেন অভ্রান্ত। আর তাই তিনি আঞ্চলিকতার সীমানা অতিক্রম করে সারাদেশে ‘নারায়ণগঞ্জের চুনকা’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের সম্পর্ক মাটির সাথে। তারা কর্ষণে মাঠি ভেদ করে শস্য তুলে আনেন, ফসল ফলান সকল মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। হাজার বছর ধরে যারা মাটির সাথে এ সম্পর্ক ধরে রেখেছেন তারা কৃষক। আলী আহম্মদ চুনকা ছিলেন কৃষকের সন্তান। তিনি তাঁর এ পিতৃপরিচয়ে গর্ববোধ করতেন।

১৯৬২ সালে বিডি মেম্বার নির্বাচিত হবার পর থেকে আলী আহম্মদ চুনকার জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভাষাআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে তিনি যেমনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তেমনি দুর্ভিক্ষ-মহামারী, বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্বিপাক, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বশক্তি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাজ ওস্তাগার সমিতি, নরসুন্দর সমিতি, নৌকা-মাঝি সমিতি, মৎসজীবী সমবায় সমিতি, নারায়ণগঞ্জ পাট শ্রমিক সমিতি, জাহাজী শ্রমিক ইউনিয়ন এমনি শ্রমজীবীদের বহু সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আলী আহম্মদ চুনকা। যারাই এসে ধরেছেন সভাপতি হবার জন্য কাউকেই ফিরিয়ে দেননি, বিমুখ করেননি। এদের নিয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর জীবন, ভাবনা ও স্বপ্ন।

স্বাধীনতাত্তোর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হবার পর তাঁর অন্যতম কর্তব্যটি দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারায়ণগঞ্জকে গড়ে তোলা। নানাহ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি তা করতে সচেষ্ট ছিলেন। আর তাই ১৯৭৮ সালে মানুষের ব্যাপক সমর্থনে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। এমনি ভালোবাসা এ অঞ্চলের ইতিহাসে কদাচিৎ কেউ পেয়েছেন। ২০০৩ সালে তাঁর দুহিতা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী যখন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়ান তখন তাঁর মূল সম্পদটি ছিলো ‘আলী আহম্মদ চুনকা কন্যা’। মানুষ আলী আহম্মদ চুনকার প্রতি ভালোবাসা থেকে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন। এখন অবশ্য সেলিনা হায়াৎ আইভীর ভাণ্ডে জমা হয়েছে অনেক কিছুই। যা তাঁর দীর্ঘ সময়ে নিজের কৃতকর্ম ও যোগ্যতার ফসল। কিন্তু তাঁর সূচনার সম্বলটি ছিলো কেবলই পিতৃপরিচয়।

সবসময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান ছিলো আলী আহম্মদ চুনকার। যেমনি ছিলেন সাহসী, তেমনি নিষ্ঠাবান, কর্মোদ্দীপ্ত, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। এখন আমরা তো হরহামেশা বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের নামের সঙ্গে কত বিশেষণ দেখতে পাই। অযোগ্যদের যোগ্য প্রমাণের প্রতিযোগিতা। কিন্তু আলী আহম্মদ চুনকার ক্ষেত্রে তা নয়। তিনি এ বিশেষণগুলোর যোগ্য ছিলেন। তিনি যেমনি মানুষকে ভালোবেসেছেন মানুষও তাঁকে ভালোবেসেছেন। ভালোবাসা না দিলে পাওয়া যায় না। তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগম। একজন সাধারণ গৃহিনী ছিলেন, কিন্তু অসাধারণ ছিল তাঁর ধৈর্য ও বৈশিষ্ট্য। দিন নেই রাত নেই আলী আহম্মদ চুনকা দলবল নিয়ে বাসায় যেয়ে হাজির- এখন তাদের জন্য খাবার তৈরি করে দিতে হবে। দিনে তো হতোই, রাত ১২টা-১টা-২টা এর কোন নিয়ম-কানুন নেই। আর মমতাজ বেগমও অধৈর্য বা বিরক্ত হতেন না। সারাদিন তো রান্নায় থাকতেনই মধ্যরাতেও শুরু হতো রান্নাবান্না। আজকের বাস্তবতায় ও কল্পনায় এ অকল্পনীয়। গত বছর মমতাজ বেগমও বিদায় নিয়েছেন। মানবসেবা হরহামেশা বলা যায় কিন্তু জীবনে এর বাস্তবায়ন সহজ কাজ নয়। স্ত্রীর এ সহযোগিতা না পেলে হয়তো তিনি জনগণের চুনকা হয়ে উঠতে পারতেন না।

১৯৮৪-র ২৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আলী আহম্মদ চুনকা অন্য এক চুনকা হিসেবে জন্ম নিয়েছেন। এ চুনকা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ও বিস্তারের ক্ষিপ্রতা পূর্বের চেয়েও অনেক বেশি। সেদিনের সে ডিআইটি চত্বর থেকে আজ পর্যন্ত যা বয়ে চলেছে মানুষের কলকণ্ঠে আর অনুরণনে। আজ মৃত্যুদিনে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা।

রফিউর রাব্বি
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়