অবিচারের চক্রে আটকে থাকা ত্বকীর জন্মদিন
৫ অক্টোবর ত্বকীর জন্মদিন। আটাশ বছর পূর্ণ হলো। বেঁচে থাকলে হয়ে উঠতো একজন পরিণত যুবক। কিন্তু কিশোর বয়সেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। ত্বকীর জন্ম হয়েছিল বিজয়া দশমীর বিকেলে। চারদিকে ঢাকের-বাদন। আনন্দ আর বেদনায় মেশানো এক অনুভূতির চারপাশ। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন এসে আযান দিলেন। আযান আর ঢাক-বাদ্যের মধ্যদিয়ে সদ্য-ভূমিষ্ঠ শিশুটি হয়তো বুঝেছিল পৃথিবীর অপার এই সৌন্দর্য সবই তাকে স্বাগত জানানোর আয়োজন। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষুদ্র জীবনের শেষে এসে জেনেগেল জগতের উল্টোপিঠের নির্মম এক সত্য, মুখ ও মুখোশে একাকার হয়ে যাওয়া আমাদের অনিবার্য এক বাস্তবতা। যেখানে কেবল দুর্জনের আধিপত্য আর অসহায় দুর্বলের আহাজারি।
রাষ্ট্র ও রাজন্যশক্তি আমাদের দেশে সর্বদা দুর্জনেরে রক্ষা করে অথবা এর উপর ভর করে চলে। অনিয়ম যেখানে নিয়মে পরিণত হয় মানুষ সেখানে অসহায় হয়ে পড়ে। ত্বকীকে আমি এ জন্মভূমিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলাম। এবং ভালোবেসেছিল। ভালোবেসে এ দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে আশায় বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, বিদেশ যেতে চায়নি। দেশে থেকে দেশের জন্য ভাবতে, করতে, বড় হতে চেয়েছিল। কিন্তু ফুল ফোঁটার আগে অঙ্কুরেই তাকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ পাঠাগার থেকে বই আনার পথে দুর্বৃত্তরা ত্বকীকে তুলে নিয়ে যায় শহরের আল্লামা ইকবাল রোডের পরিচিত একটি টর্চারসেলে। সেখানেই প্রথমে গজারির লাঠিদিয়ে পিটিয়ে ওরা ত্বকীকে অজ্ঞান করে ফেলে। মাথায় তিন দিক থেকে আঘাত করে। পরে বুকের উপর উঠে গলাচেপে শ^াস রোধকরে হত্যা করে সতের বছর পাঁচ মাস বয়সী এই কিশোরকে। কোটর থেকে দুটি চোখ উপরে আনে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেতলে দেয়। সে রাতেই বস্তাবন্দি করে লাশ ফেলে দেয় শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড়ে। লাশ ফেলে সেই টর্চারসেলে ফিরে ঘাতকরা বিরিয়ানী খেয়ে উৎসব করে। এ সবই দশ বছর আগে তদন্ত সংস্থা র্যাবের প্রকাশিত তথ্য। কিন্তু এতসব প্রকাশের পরেও বিচারটি শুরু হলো না, র্যাবের সে তদন্ত প্রতিবেদন আজো আদালতে জমা পড়লো না। অবিচারের চক্রে আটকে রইল ত্বকী।
আমাদের সংবিধানে নাকি অপরাধ সংঘটনের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়ার নিয়ম লেখা আছে। কে মানে এই সব নিয়ম! সংবিধানেতো আমার বিচার পাওয়ার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। কোথায় বিচার? ত্রিশলক্ষ শহিদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে লেখা সংবিধান এখন কেবল শাসকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষার কেতাবি দলিল, জনগণের এখানে জায়গা কই?
ত্বকী ‘ডেইলি স্টার’ পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশের স্মরণিকায় জীবনের লক্ষ্য জানাতে গিয়ে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ একবার বলেছিল মার্ক টোয়েনের উক্তি ‘অষষ মবহবৎধষরংধঃরড়হং ধৎব ভধষংব, রহপষঁফরহম ঃযরং ড়হব.’ তার খুব প্রিয়। খোঁরো খাতায় লিখে রেখেছিল বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন কবিতা, গদ্য। ছোট থেকেই ত্বকী আমার কাছে বিভিন্ন ছড়া, কবিতা শুনতে চাইত। নিজেও আবৃত্তি করতো, গান গাইত। সবাইকে ভালোবাসতো। কেউ কষ্ট পাবে এমন কথা-কাজ কখনো করতো না। কিছু পছন্দ না হলে চুপ থাকতো কিন্তু কাউকে কিছু বলতো না। বন্ধু-বান্ধব পরিজন কেউ কষ্ট পাক এইটি ছিল ওর নিয়ম বিরুদ্ধ।
হাড়িয়ে যাওয়ার পরদিন যখন ওর এ-লেভেলের প্রথম পর্বের ফল প্রকাশিত হলো সারা বিশ্বে পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নম্বর পেল, রসায়নে দেশের সর্বোচ্চ নম্বর। কিন্তু ত্বকী নেই। ত্বকী তখন শীতলক্ষ্যা নদীতে বস্তাবন্দি মৃতদেহ। ততক্ষণে সে জেনে গেছে সমাজের দুর্বৃত্ত ও বর্বরতার ভয়ঙ্কর আধিপত্যের কাছে মানুষ কী নিদারুণ অসহায়। কিন্তু ত্বকী কখনো ভীত ছিলনা। অনেক বড় একটি স্বপ্ন লালন করে চলেছিল। কিশোর বয়সেই সমাজের অনিয়মগুলো পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও একে বদলে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে খেঁরো খাতায় একটি কবিতা লিখেছিলÑ “আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে/ উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণেÑ/ মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো/ ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?”
আমি বিশ্বাস করি কোনো অবিচারই শেষ কথা নয়। বিচারের বাণী নিরবে নির্ভতে কাঁদে, কিন্তু এ কান্নাই শেষ কথা নয়। এ কান্না এক সময় বজ্রানলে জ¦লে উঠে, আঘাত করে ঘাতকের মৃত্যু-ডঙ্কায়। অসুরের বিনাশ না হলে হাজার বছরের সত্য যে মিথ্যে হয়ে যাবে।
রওনক রেহানা: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা