সাক্ষাৎকার
উত্তর-দক্ষিন দিয়ে রাজনীতি হয় না: ভিপি বাদল
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আবু হাসনাত শহীদ মো. বাদল। ভিপি বাদল হিসেবে তিনি পরিচিত। এক সময়ের তুখোড় এই ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পাঠ চুকিয়ে বর্তমানে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। সরকারী তোলারাম কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের তিনবারের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন তিনি। রাজনীতির নানা চরাই উৎরাইয়ের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিপি বাদল তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন নেতা। কিন্তু এক মঞ্চে শামীম ওসমান আর ভিপি বাদলকে অনেকদিন দেখে না দলীয় নেতাকর্মীরা। শামীম ওসমানের সাথে তার দুরুত সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে সমসাময়িক রাজনীতির নানা প্রেক্ষাপট এবং নিজের ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ‘প্রেস নারায়ণগঞ্জ’ এর সাথে। তার সাক্ষাতকারটি প্রেস নারায়ণগঞ্জের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আপনার রাজনীতিতে জড়ানোর গল্পটা কেমন ছিল?
ভিপি বাদল: এটা আমি নিজেও বলতে পারবো না। মিছিলে, মিটিংয়ে কখন যে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছি সেটা বলতে পারবো না। বিশেষ করে ৭৫’এ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে যখন হত্যা করা হয়েছিল তখন তো আমি খুব ছোট। আমি বাইরে বেরিয়েছি দেখি কিছু লোক চায়ের দোকানে বসে কথা বলছিল। একজন লোক বলে উঠলো, বাংলাদেশে নবাব সিরাজউদ্দোল্লার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা কিছু ছেলে ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে স্লোগানের সাথে মিছিল করে পালিয়ে যেতাম, পোস্টারিং করতাম। তখন সময় তো ছিল মারাত্মক। এই সময় মানুষ কথা বলতেও ভয় পাচ্ছিল। আমরা রাতে পোস্টার মারতেছি আর আনসার-ভিডিপি এসে আমাদের উপর হামলা করলো। এর আগে প্রাইমেরী স্কুলে যখন ছিলাম তখন বড় ভাইয়েরা মিছিল করতো আর স্লোগান দিতো, ‘গোল বৈঠক না রাজপথ’। আমরাও তাদের সাথে স্লোগান দিতাম। বড় ভাইয়েরা আমাদের নেতা বানিয়ে দিতো। এভাবেই বুঝিনা, জানিনা কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের মাধ্যমেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতির শুরুটা কিভাবে হলো?
ভিপি বাদল: ৭৪-৭৫ এ আমি চাষাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মেম্বার ছিলাম। আর সভাপতি নির্বাচিত হই ৭৭-৭৮ এ। এটাই আনুষ্ঠানিকতা।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ছাত্র রাজনীতির কিছু অভিজ্ঞতা বলেন।
ভিপি বাদল: আমি ৮৩-৮৪ তে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। এ সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। এর আগে জিয়াউর রহমানের হ্যা, না ভোটের সময় তাঁর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের তীব্র আন্দোলন ছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতায় আসে তখনই আমরা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ি। তোলারাম কলেজের ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনে নামি, ‘স্বৈরশাসন মানি না’ স্লোগান দিয়েছি।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: তখনকার ছাত্র রাজনীতি আর এখনকার ছাত্র রাজনীতির মধ্যে কোন পার্থক্য লক্ষ্য করেন?
ভিপি বাদল: আগে একজন ছাত্রকে মারলে সারা বাংলাদেশ কেঁপে উঠতো। আগে ছাত্রদের মধ্যে ডিসিপ্লিন ছিল। নেতারা যে নির্দেশ দিতো সেটা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। আমরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আমরা নেতার আদেশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতাম। আমাদের একটা ছেলেকে মারলে আমরা শত শত ছেলে ঝাপিয়ে পড়তাম। আমি তখন তোলারাম কলেজের ভিপি। একবার তোলারাম কলেজের কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাতে তাদের আচ্ছা মতো মেরেছে। আমি গেলাম ফতুল্লা থানায়। তখন ওসি সাহেব আমার উপর নাখোশ হলেন। আমাকেও গ্রেপ্তার করলেন। ভিপি বাদল এরেষ্ট হয়েছে শুনে তোলারাম কলেজের ২০ হাজার ছাত্র মিছিল করতে করতে ডিসির কোর্ট ঘেরাও দিয়ে দিল। আমার ওয়াইফ নাহিদা হাসনাত। তিনি মহিলা কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক ছিল, এরপর দুইবার ভিপি ছিল। সে তার কলেজের মেয়েদের নিয়ে গিয়ে ডিসির কোর্ট ঘেরাও দিল। আমাকে তখন ডিটেনশেন প্রেয়ার দিল। কিন্তু ছাত্রদের তুমুল আন্দোলনের মুখে পড়ে আমাকে আটকে রাখতে পারে নাই, ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। একটা কাককে যদি গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাহলে দুনিয়ার কাক ঝাঁক বেধে মিছিল করতে থাকে। আজকে ছাত্রদের মধ্যে সেই প্রাণ নাই, এটা আমি বিশ্বাস করি না। প্রাণ আছে। তবে কি যেন নাই আগের মতো।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আপনি তোলারাম কলেজের তিনবারের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তখন তোলারাম কলেজে সকল শিক্ষার্থীরা সহাবস্থানে ছিল। নির্বাচন হতো নিয়মমতো। এখন কেন নির্বাচন হয় না?
ভিপি বাদল: এটা আমি ওইভাবে বলতে পারবো না। এই ব্যাপারটা তো কলেজের এডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপার। তবে আমি কলেজে নির্বাচন চাই। আমাদের সময় একটা নিয়ম ছিল, থার্ড ইয়ার এডমিশনের ক্লোজিং ডে থেকে উইদ ইন থার্টি ডেইজের মধ্যে নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করতে হবে। এখন সেই নিয়মনীতি মানা হয় না। এটা কলেজের এডমিনিস্ট্রেশনের সমস্যা।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ছাত্রলীগ থেকে যুবলীগে। এরপর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। পথটা কেমন ছিল?
ভিপি বাদল: আমি ধাপে ধাপে আসছি। আমাকে তৃণমূলের প্রতীক বলতে পারেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের প্রতীকের মূল্যায়ন করেছেন আমাকে দিয়ে। আমি ৭৭’এ চাষাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছি। জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে সভাপতি হয়েছি। এর মধ্যেই তোলারাম কলেজের পরপর ভিপি হয়েছি। এরপর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হই। এদিকে ৯৬ তে পাঁচ এমপি আমাকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনের মনোনয়ন দেন। আমি মনোনয়নপত্র সাবমিট করি। যদিও আইনগত জটিলতার কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমি পৌরসভার এডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব পালন করি। আমি উপজেলা নির্বাচনও করেছি। আমার পদ পরিক্রমা বিশাল। এরপর শহর আওয়ামীলীগের কমিটিতে আসি। তারপর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: এখন জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক অবস্থা কেমন?
ভিপি বাদল: এখন দলের অবস্থা চমৎকার। আমি ৮টা থানা ও ইউনিয়নের গ্রামে-গঞ্জে ছুটে বেড়াচ্ছি। আসন্ন নির্বাচনে নৌকার প্রচারণা চালাচ্ছি।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: মেয়াদ উত্তীর্ণ উপজেলা কমিটিগুলো নিয়ে কোন উদ্যোগ আছে কি না?
ভিপি বাদল: এটা খুব যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন। কিছু কিছু জায়গায় আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ আছে, যেখানে যেখানে কমিটি সম্ভব সেটা করতে হবে। এ ব্যাপারে যদি কেউ বলে এখন না করে নির্বাচনের পড়ে করা ঠিক হবে, তাহলে সেটাই হবে।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: জেলা আওয়ামীলীগের শূন্য ৭টি পদ পূরণের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলেন?
ভিপি বাদল: আমাদের সিদ্ধান্ত প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। ৩১ জুলাইয়ের মিটিংয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল পরবর্তী মিটিংয়ে আসলে সেটা ডিক্লেয়ার করা হবে।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: দলের মধ্যে উত্তরপাড়া-দক্ষিনপাড়ার যে একটি প্রচারণা রয়েছে সেটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ভিপি বাদল: বিশাল একটা দল তো। এতোবড় দলে অভ্যন্তরীনভাবে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে। কারোর পছন্দ-অপছন্দ থাকবে। আমি আওয়ামীলীগ করি, নৌকা করি, জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী কিন্তু আমি কোন দলাদলিতে নাই। আমার পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নানা রাজনৈতিক দলের নেতা রয়েছে। আমি ওইসব দলাদলিতে যাই না। আর এই উত্তর-দক্ষিন দিয়ে রাজনীতি হয় না। যারা সংকীর্ণতায় ভোগে, যখন নেতৃত্ব অনেক রান করে, কারোর নাম হয়ে যায় তখন মানুষ এসব কথা বলেন। এই সংকীর্ণতায় যারা ভোগে তারা আওয়ামীলীগের জন্য ক্ষতিকারক। তাদেরকে বলবো, এই সংকীর্ণতায় ভোগার দরকার নাই। আসেন কোন কথা থাকলে বলেন, একত্রে কাজ করবো।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আচ্ছা রাজনীতির শুরুতে আপনার সাথে এমপি শামীম ওসমানের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আপনাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটা কেন?
ভিপি বাদল: শামীম আমার বন্ধু। আমি চাই সে পূণরায় এমপি নির্বাচিত হোক। সে একদিকে আমার বন্ধু অন্যদিকে সে আমার নেতাও বটে। মানুষ যেটা বলে সেটা আসলে ঠিক না। সবাই তো ব্যস্ত। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্ব তো অনেক বেড়ে গেছে। আমি কাজ করার জন্য ৬টা থানায় দৌড়াই অন্যদিকে সে এমপি, তাঁর হাজারটা কাজ রয়েছে। আসলে দূরত্ব কিছুই না। ব্যস্ততা আরকি। এইতো সেদিনই ফতুল্লার শামীমের প্রোগ্রাম এটেন্ড করলাম।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: শোনা যাচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আপনি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন?
ভিপি বাদল: আমি যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই সবাই ভাবছে, আমি বোধহয় নির্বাচন করবো। আসলে না, দল আমাকে নির্দেশনা দিয়েছে। আমি সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। তবে হ্যা, আমার মাতৃতুল্য নেত্রীর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মানুষের একটি চাপা ক্ষোভ থাকতেই পারে। যেখানে আওয়ামীলীগের জন্ম সেখানে গত ১৮ বছর যাবত আওয়ামীলীগের কোন এমপি নাই! ভাবা যায়? সেজন্য ডাক উঠতেই পারে নৌকার।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: মনোনয়ন যদি আপনিই পান তাহলে আপনার পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি কেমন?
ভিপি বাদল: আমার বেড়ে ওঠা মানুষের জন্য। মানুষকে খুশি করার জন্য যত প্রকার কাজ আছে সব কাজই করবো। এটাই আমার পরিকল্পনা
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আপনি মনোনয়ন পেলে জনগণ আপনাকে কেন ভোট দিবে?
ভিপি বাদল: আগে দেখতে হবে দলটা কোন দল। দলটা আওয়ামীলীগ। জনগণ আওয়ামীলীগকে ভোট দিবে। আমি যদি জনগণের জন্য ভালো করি তাহলে তারা অবশ্যই আমাকে ভোট দিবে। শান্তি ও উন্নয়নের দ্বারা অব্যাহত রাখতে হলে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে হবে।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলেন।
ভিপি বাদল: ব্যক্তিগত জীবনে আমি দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। আমার স্ত্রী নাহিদা হাসনাত সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আমার বড় মেয়ে তাঁর হাজবেন্ডের সাথে জার্মানিতে আছে। সেখানে সে মার্কেটিং এন্ড ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করছে। মেঝো মেয়ে আইইউবি তে নৃবিজ্ঞানে পড়ছে। আর ছোট ছেলে সপ্তম শ্রেণিত পড়ছে।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: আমাদের সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
ভিপি বাদল: আপনাকেও ধন্যবাদ
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম