সাক্ষাৎকার
নেতাকর্মীরা একটা হুইসেলের অপেক্ষায় আছে: এটিএম কামাল
প্রেস নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে যখন বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার এড়াতে নেতাকর্মীরা আড়ালে ঠিক তখনই দেশে ফিরেছেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল। দীর্ঘ ৭ মাস পর চিকিৎসা শেষে আমেরিকা থেকে শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) রাতের ফ্লাইটে ফিরেছেন দেশে। দেশে এসেই নেতাকর্মীদের একত্র করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন তিনি। সকল ভেদাভেদ ভুলে একসাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামার আহ্বান জানাচ্ছেন সকল নেতাকর্মীদের। দলের বর্তমান অবস্থা, আন্দোলন, আগামী নির্বাচন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রেস নারায়ণগঞ্জ এর সাথে। তার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারটি প্রেস নারায়ণগঞ্জের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো
বিএনপির সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে এটিএম কামাল বলেন, রাজনীতি তো আর এখন নাই। রাজনীতি এখন নির্বাসনে। এটা কেবল বিএনপির জন্য না, আওয়ামীলীগের জন্যও। আওয়ামীলীগের রাজনীতিবিদদের হাতেও এখন রাজনীতি নাই। রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এই ব্যাপারটা রাজনীতির জন্য অনেক বড় কালোছায়া। এই সংস্কৃতিটার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে যার থেকে কেউ রেহাই পাবে না। সারাজীবন কেউ সরকারি দল থাকে না। আজ সরকারি তো কাল বিরোধী। সুতরাং এর ভুক্তভোগী তাদেরও হতে হবে। এটা প্রকৃতি বলে, আমি বলি না। প্রকৃতি কাউকেই ক্ষমা করে না।
পুলিশের এই অবস্থানের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এই সরকার জানে তাদের কোন জনসমর্থন নাই। তাই তারা লাঠির মাথায় রাজনীতিকে রেখে জেল, জুলুম, গুম, খুন, নির্যাতন, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরণের মিথ্যাচার করে আজকে রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পুলিশ হলো রক্ষক। কিন্তু রক্ষকই এখন গায়েবী মামলা করে। এদের কাছে মৃত ব্যক্তি, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তি, হজ্ব করতে যাওয়া ব্যক্তিও নিরাপদ নয়। মৃত ব্যক্তিকেও মামলার আসামী করে রাখছেন। এই যদি হয়, তাহলে কোথায় মানবতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা?
বর্তমান সরকার পুলিশকে দিয়ে এসব করাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ। সরকার তাদেরকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। তবে সরকার যে এই কাজটা করছে সেটা পরবর্তী সরকারও করতে পারে। সুতরাং সরকারের এটা ব্যাড প্রাকটিস।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাবার পূর্বে এবং পরে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপি আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা যে কারণে সাজানো, মিথ্যা একটি মামলায় নেত্রীকে জেলে পাঠিয়েছে সেটা সফল হয়নি। তারা ভেবেছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা দমে যাবে। কিন্তু তাতো হয়ই নি উল্টো তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিএনপির কোন নেতাকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং বিএনপি এখন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
‘বিএনপির নেতাকর্মীরা কেবল একটি সিগন্যালের অপেক্ষায় আছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন কেবলমাত্র একটি হুইসেলের অপেক্ষায় আছে। এবার কোন ওয়ার্ম আপ কর্মসূচি হবে না। সরকার পতনের চুড়ান্ত আন্দোলনের জন্য বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। কেবল হুইসেলের অপেক্ষা। খুব শীঘ্রই কেন্দ্র থেকে সেই সিগন্যাল আসবে বলেও জানান তিনি।
মানুষের পিঠ কিন্তু দেয়ালে ঠেকে গেছে, প্রশ্নটা এবার অস্তিত্বের। একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটার পর একটা কালো আইন করতেছে, মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করতেছে, সাংবাদিকদের লেখার স্বাধীনতা হরণ করতেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরেও তাদের কালো থাবা। তারা যদি ভয় না পেতো তাহলে তারা এগুলো করতো না। এখন এগুলো করে লাভ নাই। সরকার পতনের ঘন্টা বেজে গেছে। সরকার যদি এখনও স্বেচ্ছাচারিতা করতে চায় তাহলে দেশের মানুষ আর মানবে না।
বিদেশে যাবার পর এটিএম কামালকে নিয়ে নানা আলোচনা-সামলোচনা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, হামলা-মামলার থেকে বাঁচতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এটিএম কামাল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা তো মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। এমন তো না যে, আমি ক্ষমতায় আসার পরে দেশে ফিরেছি। এমন সময়ে আমি দেশে ফিরেছি যখন একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের উপর। অনেকেই বলেছে, এখন দেশে যাচ্ছেন কি আগুনে ঝাপ দিতে? আমি তাদের বলেছি, আমার চিকিৎসার কারণে, পারিবারিক কারণে বিদেশে ছিলাম। এখন আমার কাজ শেষ সুতরাং বিদেশে থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি তো আর স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকতে যাই নাই। আমার এই আসাটা প্রমাণ করে, তারা মিথ্যা ও ভুল ধারণা করছে।
হঠাৎ ফিরে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি যে কাজে গিয়েছি সে কাজ শেষ তাই আমি ফিরে এসেছি। অনেকেই আরো একমাস পরে যেতে বলেছিল কিন্তু আমি বলেছি, আমি তো এখানে সেফ হতে আসি নাই। সবচেয়ে বড় কথা আমাকে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন স্বয়ং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যখন কারাগারে তখন তো আমি নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য বিদেশে থাকতে পারি না। আমি আমার কাজ শেষ করছি, চলে আসছি। আমি এর আগে তার মুক্তির জন্য ওয়ান ইলেভেনে আমরণ অনশনও করেছি।
এতোদিন পর দেশে ফেরার পর নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, নেতাকর্মীরা বলে, ‘আপনি ফিরে এসেছেন আমাদের আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের মনোবল অনেক বেশি বেড়ে গেছে।’ আমার এই নারায়ণগঞ্জে উপস্থিতিই নাকি তাদের চাঙ্গা করে দিয়েছে, তাদের ভয় কমে গেছে। নেতাকর্মীরা বলে, ‘আমরা একটু হতাশ ও ভীত ছিলাম। কিন্তু এখন আমরা আর হতাশ কিংবা ভীত না। কারণ এখন আমরা জানি, এটিএম কামাল ভাই আছে শহরে।’
মহানগর বিএনপির অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশ যাবার আগে আমরা সবাই মিলে একত্রে সকল কর্মসূচি সফল করছি। বিদেশ যাবার পরেও তারা এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গায়েবী মামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।
মহানগর বিএনপিতে কালাম-সাখাওয়াত গ্রুপ তৈরি হবার ব্যাপারে তিনি বলেন, এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে। মহানগর বিএনপি কখনো দুটো ছিল না, আগামীতেও থাকবে না। মাঝখানে হয়তো মান অভিমানের কারণে কিছুটা বিভক্তি দেখা গেছে তবে সেটা আর দেখা যাবে না। নেত্রী যেখানে জেলে সেখানে এসব মান অভিমান ভুলে যেতে হবে।
মহানগর বিএনপিতে সাখাওয়াত হোসেনের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, উনি আমাদের কমিটিতে জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি। উনি হয়তো কোন কারণে দূরে সরে গিয়েছিল। উনি আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা একটু বিভ্রান্ত হয়েছে। আমি মনে করি এখন আলাদা কর্মসূচি করার যেমন কোন সুযোগ নাই। তেমনি বিভ্রান্ত হবারও সুযোগ নাই। সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার যে আন্দোলন শুরু হবে সেখানে আমাদের একত্রে নামতে হবে।
এটিএম কামালের অবর্তমানে মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি এড. সাখাওয়াত হোসেন খান দলের আরেক সহ সভাপতি এড. সরকার হুমায়নকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেন। যার সাথে একমত ছিলেন না স্বয়ং সভাপতিসহ দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী। এ নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। দলটির সভাপতি ও সাবেক এমপি এড. আবুল কালাম এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে এটিএম কামাল বলেন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের বিষয়ে আমার কোন আপত্তি ছিল না যদি সেটা সঠিক নিয়মে হতো। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ হতেই পারে কিন্তু সেটা করবে নির্বাহী কমিটি। নির্বাহী কমিটি বসে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা করতে পারে। নির্বাহী কমিটি চাইলে বিশেষ কারণে সহ সভাপতিকেও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ দিতে পারেন। কিন্তু একা একা কেউ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বিএনপি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিএনপির গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে যদি ব্যক্তিসিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয় সেটা তো গ্রহনযোগ্য হতে পারে না।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সকল ভেদাভেদ ভুলে একসাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়ে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সব ভেদাভেদ ও বিভক্তি ভুলে বাকশালি সরকারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সবাইকে মাঠে নামতে হবে। মুরভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি যেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না, তেমনি গলিতে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করলেও কাজ হবে না।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম