দুই যুগে সেক্রেটারি খোকন সাহা ‘শেখ হাসিনার বাইরে আমি কিছু না’
সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): ১৯৭৫ সালে ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন খোকন সাহা। পেশাগত জীবনে আইনজীবী অ্যাড. খোকন সাহা দীর্ঘ সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। তিন মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পার করছেন দুই যুগ। বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে একই পদে দুই যুগ সময় পার করছেন দাবি করেছেন অ্যাড. খোকন সাহা। রাজনৈতিক জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে গেলে এই প্রাপ্তিই তার কাছে সবচেয়ে ‘সুখকর’ মন্তব্য খোদ খোকন সাহার। প্রেস নারায়ণগঞ্জকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের খুটিনাটি তুলে ধরলেন। এই সাক্ষাৎকারে রাজনীতির শুরু থেকে নানা চড়াই-উৎরাই, অর্জন-আক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রেস নারায়ণগঞ্জের চীফ রিপোর্টার সৌরভ হোসেন সিয়াম।
রাজনীতির শুরু
রাজনীতির শুরুর কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন অ্যাড. খোকন সাহা। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ঘুম থেকে উঠে রেডিওতে মেজর ডালিমের কণ্ঠে ‘স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ শুনতে পেলাম। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি নাই। আমি তখন নগন্য কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগে যোগদান করি। নারায়ণগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। তখন রাজনীতিতে অনেক ক্রাইসিস। রাজনীতি করতে লোক পাওয়া যাইতো না। ’৭৬ সালে এক মিলাদের দোয়ায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী উচ্চারণ করতে ইমাম ভয় পাচ্ছিলেন। অনেক চেষ্টার পরও দোয়ায় বঙ্গবন্ধুর নাম বলানো গেল না। পরের বছর আরেকটা মিলাদের আয়োজন করা হলো। অনেক নেতাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অতিথির মাত্র তিনজন এসেছিলেন। পরে তোলারাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাণিজ্য শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। সভাপতি হলো বন্ধু আবু হাসনাত শহীদ মো. বাদল।
নারায়ণগঞ্জে রাজনীতির অবস্থা তখন খুব ঘোলাটে ছিল। আমি আমার নেতা শামীম ওসমানের বাবা সামসুজ্জোহা সাহেবের আশীর্বাদে রাজনীতি করতাম। আড়াইহাজারের সম্মেলনে আমার নেতা সামসুজ্জোহাকে পরাজিত করা হয়েছিল। তারপর তোলারাম কলেজ নির্বাচনে আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, জোহা সাহেবকে ছাড়তে হবে। শামীম ওসমানকে ভিপি ক্যান্ডিডেট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জিএস ক্যান্ডিডেট ছিল জাহাঙ্গীর আলম। সেখানে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করা হলো।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন
তখন এরশাদ ক্ষমতা দখল করলো। আমরা নয়জন মিলে প্রথম এরশাদবিরোধী মিছিল বের করলাম। সেই মিছিলে আমি, আনিসুর রহমান দিপু, হান্নান আহমদ দুলাল, জিএম ফারুক, বাসদের ছাত্র সংগঠনের নেতা কালাম, বাবুরাইলের মাইনুদ্দিন বারী, বিমল ব্যানার্জি, খায়ের ভাই, মাকসুদ ছিল। ওই মিছিলের কারণে পরে অনেক হয়রানির শিকার হইছি। এরপর অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে এরশাদ উৎখাত হলো। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সিংহভাগ টাকা ও লোকের যোগান দিত শামীম ওসমান। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অন্তদ্বর্ন্দ্বের কারণে বিভক্ত হয়ে গেল। সংঘত কারণেই আমরা বিশাল একটা গ্রুপ সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে রয়ে গেলাম। আলাদা ছাত্রলীগ করলাম। কোমড়ে লিফলেট নিয়ে সিনেমা হলে যাইতাম, সিনেমা শেষ হলে লিফলেট ছুড়তাম। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুক্ষ¥ কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হলো। পরে আমরা বিভক্তি থেকে একদল হলাম।
ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগে
১৯৮২ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নাজমা রহমান সভাপতি, শামীম ওসমান সাধারণ সম্পাদক এবং আমি দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। পরে বিএনপির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করি। সে সময় অনেক মামলা দেওয়া হয় আমার নামে। ১৯৯৬ সালে ১১ সেপ্টেম্বর শামীম ওসমান সভাপতি, আনিসুর রহমান দিপু ও আমি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলাম। পরে শামীম ওসমান আমাদের নিয়ে বসে দিপুকে কম্প্রোমাইজ করতে বললো। পরে বন্ধু দিপু সরে দাড়ালো। সে অনেক ত্যাগী নেতা।
২০০১ সালের চরম দুর্দিনে পালিয়ে থেকেও দলকে সুসংঠিত করতে কাজ করি। এরপর আবার সম্মেলন হলো। আমি আমার দুর্দিনের সাথীদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ওই সময় ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। ২০০৩ সালে আমার এলাকা (গলাচিপা গোয়ালপাড়া) থেকে এমন কিছু ছেলে বেরিয়ে পাশে এসে দাড়ালো তাদের কথা না বললেই নয়। পরে সময় সভাপতি পদে আনোয়ার ভাই আর সাধারণ সম্পাদক আমি বিজয়ী হলাম।
একে ফোরটি সেভেন গ্রুপ
কথায় কথায় খোকন সাহা জানালেন ‘একে ফোরটি সেভেন’ এর কথা। বললেন, “আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। আমি আর দিপু গ্রুপটাকে বলতাম: একে ফোরটি সেভেন গ্রুপ। তখন পৌরসভা নির্বাচন। দিপু গ্রুপটাকে অ্যাক্টিভ করতে বললো। আকরাম ভাই তখন আনোয়ার ভাইকে সিলেক্ট করলো। কিন্তু আনোয়ার ভাই দাড়ালে তৈমুর ভাই (বিএনপি নেতা) দাড়ায়ে যাইতো। তখন বাহাউল ভাই ছিলেন সোনারগাঁয়ের এমপি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। বাহাউল ভাই আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বললাম, আনোয়ার ভাই নিঃসন্দেহে যোগ্য নেতা কিন্তু তিনি পাশ করবেন না। আইভীরে দিলে সম্ভাবনা আছে। আমি ভাইরে যুক্তি দিলাম। বললাম, আপনারা দল চালান, সিদ্ধান্ত আপনারা নিবেন। পরে শামীম ওসমানও আইভীর ব্যাপারে সম্মতি দিলো।
আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহার দুই যুগ
১৯৯৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথমবার নারায়ণগঞ্জ শহর (সিটি) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় সভাপতি ছিলেন শামীম ওসমান। এরপর ২০০৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরে ২০১৩ সালে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে সম্মেলন ছাড়াই আরও একবার মহানগর (শহর থেকে মহানগর নামকরণ) আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। টানা তিন মেয়াদে দুই যুগ পার করছেন এই রাজনীতিক।
নিজেকে সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণতম সাধারণ সম্পাদক দাবি করেছেন খোকন সাহা। তিনি বলেন, টানা ২৪ বছর কোন ইউনিটে কেউ সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারে নাই।
রাজনীতির বাইরে পেশাগতভাবে খোকন সাহা একজন আইনজীবী। নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতে বেশ নামডাক রয়েছে তার। জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। ছিলেন দুইবারের সাধারণ সম্পাদক। তার রাজনীতি কিংবা পেশাগত জীবনে যেখানেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সেখানেই সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে দেখা গেছে বেশিরভাগ সময়। এ নিয়ে তিনি নিজেও বলেন, “আমি সভাপতি হতে চাইতাম না। সাধারণ সম্পাদক হতেই ভালো লাগে। কাজ করা যায়।”
অ্যাড. খোকন সাহা বলেন, “আমি কোর্ট থেইকা প্রচুর টাকা কামাইছি। একটা ছোট অংশ পরিবারের জন্য রাইখা বাকি সব নেতাকর্মী ও দলের জন্য খরচ করছি। আমি মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আজ ২৪ বছর। কখনও ১০ টাকা চাঁদাবাজি করি নাই। কেউ চাঁদাবাজি, জমি, বাড়ি দখল, টেন্ডারবাজির প্রমাণ দিতে পারে তাহলে রাজনীতি থেকে সরে দাড়াবো। আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে এতগুলো বছর কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে রাজনীতিতে ঢুকেছি। খুনিদের বিচার হইছে, আমাদের টার্গেট কিন্তু শেষ হইছে। যেদিন নেত্রী বলবেন সেদিন থেকে অবসরে চলে যাবো। আমি এখনও গাছতলায় বইসা সাধারণ মানুষের রাজনীতি করি।”
রাজনীতির সেকাল-একাল
আমরা একটা স্টার সিগারেট পাঁচজনেও খাইছি। এখন রাজনীতি অনেকটা বাণিজ্যিক। লোভ ত্যাগ করে মানুষের জন্য রাজনীতি করতে হবে। যারা ছাত্রলীগ করে তাদের প্রতি আমার ম্যাসেজ: সততা ও নিষ্ঠার সাথে থাকো। নেতা হওয়ার জন্য না, মানুষের জন্য কাজ করো।
চাওয়া-পাওয়ার হিসেব
দীর্ঘ এই রাজনৈতিক জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষলে অনেক বিষয় সামনে চলে আসে। এসব হিসেব রাখতে চান না খোকন সাহা। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন। মনোনয়নপত্রও কিনেছিলেন তিনি। তবে শেষ মুহুর্তে এই আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছাড় দেওয়া হয়।
মনোনয়ন না পাওয়াতে কোন আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দল তখন আমাকে যোগ্য মনে করে নাই, তাই দেয় নাই। এতে আমার কোন আক্ষেপ নাই। আমি ২০১৩ সালে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে স্কুল নিয়ে কাজ করার কথা নেত্রীকে বলেছিলাম। নেত্রী তখন বলেছিল, ‘নাহ্। তোমার এখন স্কুল করার দরকার নাই। তুমি দলটা করো।’ এটা আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি।”
“কিছু লোক আছে যারা বিরোধীতার জন্যই কেবল বিরোধীতা করে। আমি তাদের দলের লোক না। শেখ হাসিনার বাইরে গিয়ে আমি কিছু না” মন্তব্য করেন খোকন সাহা।
তবে আক্ষেপের কথাও জানালেন তিনি। এই আক্ষেপ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নিয়ে। খোকন সাহা বলেন, “২০১৬ সালে দলীয় প্রার্থী আইভীকে পাশ করাইতে আর্থিক, সামাজিকভাবে সবকিছু করছি। দলের কাজ করতে হইবো। এই বিষয়টা আমার মধ্যে কাজ করছে। আমি শামীম ওসমান, আইভী চিনি না। দলের জন্য কাজ করতে হইবো। এটাই কেবল বুঝি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই পর্যন্ত একটা ধন্যবাদও পাই নাই। কত দুর্ভাগা মহানগরের সেক্রেটারি! ন্যূনতম সৌজন্যবোধও তো আছে। এইটা আমার ক্ষোভ, আক্ষেপ। আইভী নির্বাচিত হওয়ার পর মানুষের আশা আকাঙ্খা পূরণ হয় নাই। আওয়ামী লীগ আমারে বহিষ্কার করলে করবে কিন্তু এটাই সত্য। মেয়র ক্ষুব্দ হতে পারে। কিন্তু তাতে আমার যায় আসে না। মেয়র ক্ষুব্দ আবার শামীম ওসমান খুশি হইলে আমার কিছু যায় আসে না।”
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম