শহরের এক টুকরো ফুলের হাট
সুস্মিতা পাল সেতু (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য যখন মুসুল্লিরা মাত্র ঘুম থেকে ওঠে, সেই সময় রুটি-রুজির দায়ে কিছু মানুষ নদী পাড়ি দেয়। শীতের কুয়াশাকে অতিক্রম করে মাথায় ফুলের বোঝা নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসে নগরে। কেউ চাদর কেউ লুঙ্গি কেউবা ভারী পলিথিন বিছিয়েই বসে পড়েন ফুলের ঢালী সাজিয়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ছুটি কাটায় না তারা।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের নারায়ণগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন ক্লাব মার্কেটের পুরো ফুটপাত জুড়ে প্রতিদিন বসে অস্থায়ী এক ফুলের হাট। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে এই অস্থায়ী ফুলের হাট। ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে বাড়তে থাকে ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতাদের ভীড়। বিভিন্ন প্রজাতি আর রং-বেরঙের ফুলের গন্ধে মুখরিত হয়ে ওঠে ফুটপাতটি।
গাঁদা, শিউলি, করবী, চন্দ্রমল্লিকা, অপরাজিতা, ধুতরা, রং-বেরঙের বিভিন্ন জাতের জবা যেমন: ঝুমকো জবা, রক্ত জবা, হাইব্রিড জবা ইত্যাদিসহ আরো অনেক রকমের ঋতুভিত্তিক ও দেশীয় ফুলের সমারোহ এই বাজারে সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ঋতুভেদে কাঠমালতি, বেলী, শিউলী, হাসনা হেনা ইত্যাদি ফুলগুলোর আমদানি ও তার চাহিদা থাকে । দেশীয় ফুল ছাড়াও বিদেশী ও সৌখিন ফুল যেমন জারবেরা, গ্লাডিয়াস, রজনীগন্ধ্যা, গোলাপ, মামফুলসহ বিভিন্ন সৌখিন ফুলও স্থায়ী ফুলের দোকানের চেয়ে কম দামে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। ফুলের সাথে সাথে সনাতন ধর্মালম্বীদের পূজা, বিয়ে ও শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের বিভিন্ন উপাচার দূর্বা, বেলপাতা, আমসরা, আমকাষ্ঠ, পাটখড়ি, যজ্ঞডুমুর ইত্যাদি দুর্লভ সব উপাচার পুরো শহরে একমাত্র এই বাজারেই পাওয়া যায় ।
ফুলের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে নেই ফল বিক্রেতারাও। ঢুলি-চাঙারিতে, কেউ কেউ মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে সাজিয়ে বসে হরেক রকম ফল। বোতলে করে গরুর দুধও বিক্রি করে গোয়ালারা।
ফুল-ফল ছাড়াও বিভিন্ন ভেষজ গাছের পাতা ও ছাল যেমন নিমপাতা, মেহেদি পাতা, বতুয়া শাক, দন্ডকলস, ধুতরা গোটা, ঘৃতকুমারী, অর্জুন ছাল, বাসক পাতা, থানকুনি পাতাসহ বিভিন্ন ঔষধি টোটকাও এই অস্থায়ী বাজারে পাওয়া যায় ।
এই হাটের বিক্রেতারা প্রায় সবাই আসেন নদীর ওপার বন্দর উপজেলা থেকে। বিক্রেতাদের মধ্যে অনেকেই আবার ফুল চাষী। এসব চাষীরা তাদের নিজস্ব জমিতে ফুল চাষ করে। ফুল চাষী লিটন হালদার। তার বাড়ি বন্দর উপজেলার সাবদী গ্রামে। তিনি জানান, পিতার হাত ধরেই তার এই বাজারে আসা। প্রায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পেশার সাথে জড়িত। বাবা মারা যাবার পর তিনিই এই পেশায় পুরোপুরি জড়িয়ে যান। তিনি আরো জানান, পাঁচ হাজার টাকার বীজ ও সার কিনে প্রায় দ্বিগুন টাকা লাভ করা যায় এই ব্যবসায়। পূজার মৌসুমে চাহিদা ও ফুলের দাম আরো বেড়ে যায়। এ বাজারের বেশিরভাগ ক্রেতা সনাতন ধর্মালম্বী হলেও বিশেষ দিবসগুলোতে সব ধর্মের মানুষরাই ফুল কিনতে আসেন বলে জানিয়েছে বিক্রেতারা ।
বিভিন্ন বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেল বেশকিছু সংগ্রামী জীবনের গল্প স্বামীর অসুস্থ হবার পর থেকে এই হাটে ৩০ বছর ধরে শাক ও ভেষজ পাতা বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর চেষ্টা করছেন কল্পনা রাণী (৪০)। প্রতিদিন তার আয় হয় একহাজার কখনো বারো’শ টাকা। এই দিয়ে চালান সংসার ও ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ। কয়েকমাস আগে দিলেন তার মেয়ের বিয়েও ।
অপরদিকে ছেলে-মেয়ে সচ্ছল থাকা সত্ত্বেও একজন সন্তানও বৃদ্ধ মো. মকবুলের (৭০) দায়িত্ব নিতে চায় না। তাই পেটের দায়ে নামেন এই ব্যবসায়। শহরেই তার বাসা। তিনি এই বাজারের পাইকারী বিক্রেতাদের কাছ থেকে ফুল কিনে তা খুচরা দামে বিক্রি করেন।
সকল ফুল বিক্রেতাদের গল্পগুলো প্রায় একই ধাঁচের। শখে নয় , সবাই এসেছেন দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ।
বিক্রেতা ছাড়াও কথা হয় ক্রেতাদের সাথে। শহরের আমলাপাড়া নিবাসী মলি রাণী (৩২) বলেন, পূজোর ফুল-দূর্বা-ফল-দুধ সব কম দামে একজায়গায় পাওয়া যায়, তাই প্রতিদিন এখানেই পূজোর ফুল কিনতে আসি ।
বিশেষ পূজোর মৌসুমে সময় ফুলের সংকট দেখা দেয় বলে অভিযোগ করেন অনেক ক্রেতারা। নগরে সুলভ মূল্যে এই বাজারে ফুল কিনতে পাওয়া যায় বলে সনাতন ধর্মাল্বীরা নিত্যপূজার ফুল কিনতে প্রতিদিন এই বাজারেই আসেন। পরিচিত ও আত্মীয়-পরিজনদের সাথে দেখা হলে সেরে নেন কুশল বিনিময়ের কাজটিও। কিনে দেন একে অপরকে ফুল।
এই ফুল বাজারের উৎপত্তি বা শুরু ঠিক কবে থেকে হয়েছে তা জানা না গেলেও বিভিন্ন ফুল বিক্রেতার কাছে থেকে জানা যায় , পূর্বে এই বাজারটি ক্লাব মার্কেটের অপরপাশে বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে বসত। পথচারী ও উকিলপাড়া হোসিয়ারি ব্যবসায়ীদের চলাচলের অসুবিধার কথা ভেবে প্রায় ৫-৬ বছর আগে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি এই ফুল বাজারটি ক্লাব গেইটের ফুটপাতে স্থানান্তর করেন বলে জানিয়েছে ফুল বিক্রেতারা ।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম