ইট-পাথরের শহরে বেড়েছে পাখিদের আনাগোনা

নারায়ণগঞ্জের ইট-পাথরের শহরে বেড়েছে পাখিদের আনাগোনা। শহরের যেসব এলাকায় বড় বড় গাছ রয়েছে, সেখানে এখন পাখির কিচিরমিচির ও ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে গাছের ডালে বসা পাখির কলতান শহরবাসীকে বিমোহিত করছে। একসময় যেখানে পাখির দেখা মিলত না, এখন সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি অবাধ বিচরণ করছে। যেসব এলাকায় গাছপালা রয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এখন দোয়েল, ময়না, টিয়া, মাছরাঙা, বাবুই, চড়ুই, টুনটুনি, শালিক, ঘুঘু ও কোকিলের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে থাকা গাছগুলোর ডাল থেকে অবিরত আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। গাছের ডাল থেকে ডালে ওড়াউড়ি করছে পাখির দল।
এই পরিবর্তন হঠাৎ আসেনি, বরং এটি দীর্ঘ পরিকল্পিত সবুজায়ন কর্মসূচির সফল ফলাফল বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল শহরকে সবুজায়ন করা। ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট মেয়র পদ থেকে অপসারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করেছেন।
সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ শহরে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। তার উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গাছ লাগানো হয়, যা বর্তমানে নগরীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
দেওভোগের শেখ রাসেল পার্ক, যা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি পার্ক নামে পরিচিত, সেখানে কয়েক হাজার বনজ ও ফলজ গাছ রোপণ করা হয়েছে। পার্কের গাছে গাছে লাগানো হয়েছে পাখির কৃত্রিম বাসা। এছাড়া জল্লার পাড় লেকের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হয়। একইভাবে সিদ্ধিরগঞ্জ লেকের চারপাশেও সবুজায়নের জন্য গাছ রোপণ করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রত্যেকটি সড়কের পাশে খালি জায়গা ও রোড ডিভাইডারে গাছ লাগানো হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিচালিত হয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, যা শহরের বায়ু মান উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নগরবাসীকে ছাদ বাগান করতে উৎসাহিত করতে বাড়ির মালিকদের নির্দিষ্ট পরিমাণ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ফলে অনেকেই ছাদ বাগান গড়ে তোলেন, যা নগরীর পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
পরিবেশ কর্মী আফসার বিপুল জানান, "আমার বাসার কাছেই রাসেল পার্ক। সেখানে বটগাছে লাল বটফল খেতে বসন্ত বৌরি পাখি দেখেছি, যা পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ ধরনের পাখি সাধারণত তাদের উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে দেখা যায় না।"
তিনি আরও বলেন, "পলাশ গাছে মৌটুসী পাখি লক্ষ্য করেছি, যা সাধারণত শহরাঞ্চলে দেখা যায় না। কারণ, এই পাখি প্রধানত মধুর উপর নির্ভরশীল, যা এখন রাসেল পার্কেও পাওয়া যাচ্ছে।"
পরিবেশবিদরা মনে করেন, শহরে গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে পাখির সংখ্যা আবারও হ্রাস পেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে, যা পাখির অভয়াশ্রম ছিল। এর ফলে অনেক পাখি বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
পরিবেশ কর্মী আফসার বিপুল সতর্ক করে বলেন, "গাছ না থাকলে পাখিও থাকবে না—এটি স্বাভাবিক। আমরা যদি শহরে গাছের সংখ্যা আরও বাড়াতে পারি, তাহলে পাখির বিচরণও বৃদ্ধি পাবে।"
সবুজায়নের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারায়ণগঞ্জ এখন পাখিদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। নগরবাসী প্রত্যক্ষ করছে প্রকৃতির এই ইতিবাচক পরিবর্তন। একসময় যেখানে কংক্রিটের জঞ্জালে ঢাকা ছিল নারায়ণগঞ্জ, এখন সেখানে পাখির কলতানে মুখরিত এক নতুন শহর গড়ে উঠেছে।