সোনারগাঁয়ের আগাম জাতের লিচু, ফলন কমে হতাশ বাগানমালিকরা
আগাম জাতের হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার লিচু গাছে দ্রুত ফল আসে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুত বাগান মালিকরা লিচু সংগ্রহ করে বাজারজাত করে থাকেন। তবে চলতি বছর সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া, অত্যধিক তাপ ও অসময়ে শিলাবৃষ্টিতে লিচুর উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে, আশানুরূপ মুনাফা করতে না পারার আশঙ্কা করছেন বাগান মালিকরা।
বাগান মালিক ও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার মাটি ও আবহাওয়া লিচু উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। যদিও, কেবল সোনারগাঁ উপজেলাতেই লিচুর চাষ হয়। এ বছর উপজেলার ১২টি গ্রামের অন্তত ১০৭ হেক্টর জমিতে ৭৮০টি বাগানে লিচুর বাণিজ্যিক চাষ করা হয়েছে। সাধারণত কদমি, পাতি ও চায়না-৩; এই তিন প্রজাতির লিচুর উৎপাদন হয় এসব বাগানে। তবে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে গতবছরের তুলনায় এবার ফলন কম হয়েছে।
সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা ইসলাম বলেন, গতবছর বাগানগুলোতে ৭০০ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর বাগানের সংখ্যা বাড়ায় উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা ছিল। কিন্তু অত্যধিক তাপমাত্রা ও শিলাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হওয়ায় এ বছরও উৎপাদন ৭০০ মেট্রিক টনে ঠেকবে বলে ধারণা এ কর্মকর্তার।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পানাম নগর, চিলারবাগ, উত্তর ষোলপাড়া গ্রামে ঘুরে রাস্তার দুইপাশে সারি সারি লিচু বাগান দেখা যায়। এসব বাগানের অধিকাংশ মালিক তাদের বাগান মৌসুমভিত্তিক ভাড়া দেন। গাছে ফুল আসার থেকে ফল ধরার পর পরিচর্যা ও পরে লিচু বাজারজাত করা পর্যন্ত সবকিছুই করেন ভাড়াটে চাষিরা।
এমন এক ভাড়াটে চাষি রনি আহমেদ এবার ৩০ শতাংশের একটি বাগার ৮৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। বাগানে গাছের পরিচর্যা ও অন্যান্য কাজে খরচ করেছেন আরও ২৫ হাজার টাকা। তবে, ভালো ফলন না হওয়াতে অনেকটা হতাশ রনি।
“আমি অন্তত ৩০ হাজার লিচু পাবো বলে আশা করছিলাম। কিন্তু গত দুইদিনে লিচু পাইছি মাত্র ২০ হাজার। অথচ দুই বছর আগেও একই বাগান থেকে ৩৬ হাজার লিচু পাইছি। এই বছর সময়মতো বৃষ্টি হয় নাই, উল্টো অনেক তাপ ছিল। এইজন্য লিচুগুলো ঠিকমতো বড় হয় নাই। তাও ফলন ভালো হইতো কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে অনেক লিচু নষ্ট হইয়া গেছে”, বলেন এ চাষি।
গাছ থেকে লিচুগুলো কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি আড়তে বিক্রি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রনি। তিনি বলেন, “বাগানভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে হাতে কিছু টাকা থাকবো। কিন্তু পুরো মৌসুমে যে পরিশ্রম করছি তার কাছে এইটা কিছু না।”
এ অঞ্চলের বড় বাগানের মালিকরাও একই অনুভূতি জানান।
উত্তর ষোলপাড়া গ্রামে ২৭০ শতাংশেরও বেশি জমিতে একটি লিচু বাগান করা হয়েছে। এ বাগানে লিচু গাছ রয়েছে অন্তত ৮৬টি। মঙ্গলবার দুপুরে বাগানটিতে কয়েকজনকে লিচু পেড়ে তা বাজারজাত করার প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়।
এই বাগানের দেখাশোনা করেন ৫৯ বছর বয়সী বেনু মোল্লা। দীর্ঘ ৩৫ বছর বিভিন্ন লিচু বাগানে কাজ করা এ বৃদ্ধ বলেন, বাংলা বর্ষপঞ্জির মাঘ মাসের শেষদিকে সোনারগাঁয়ের লিচু গাছে ফুল দেখা যায়। লিচু পাড়া শুরু হয় বৈশাখের মাঝামাঝি অবস্থায়। লিচুর ফলন ভালো হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও অনুকূল আবহাওয়া জরুরি।
বাগানটি ভাড়ায় নেওয়া মো. হানিফ বলেন, “এইবার গাছে ভালো ফুল আসছিল। এইটা দেইখা অন্যবছর একটি বাগান লিজ নিলেও এবার তিনটা নিছি। কিন্তু এখন পড়ছি মুশকিলে। রইদের তাপে কোনো সমস্যা ছিলো না, যদি সময়মতো বৃষ্টি হইতো। যেই আশায় তিনটা বাগান লিজ নিছিলাম সেই আশা পূরণ হইবো না। কারণ ফলন কম।”
উপজেলার বাগানগুলোতে আশানুরূপ ফলন না আসলেও লিচু বাজারজাত করতে কোনো প্রকার ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে জানান বাগান মালিক ও ভাড়াটে চাষিরা। বেশিরভাগ লিচু উপজেলার মোগরাপাড়া বাজারে ফলের আড়তে বিক্রি হয়, যা পরবর্তীতে রাজধানী ও আশেপাশের ফলের বাজারে পৌঁছায়। প্রতি হাজার লিচু ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার বিক্রি হচ্ছে এ বছর। তবে চায়না-৩ জাতের লিচুর দাম তুলনামূলক বেশি।
এছাড়া, ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং পানাম নগরে বেড়াতে আসা পর্যটক ও দর্শনার্থীরাও প্রায় সময় লিচু কিনে নিয়ে যান বলে জানান বাগান মালিকরা।
কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা বলেন, বারো ভূঁইয়ার শাসনামলে সোনারগাঁ বাণিজ্যের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। পর্তুগিজরা প্রথম এ অঞ্চলে লিচুর চারা নিয়ে আসেন, তখন থেকেই এই অঞ্চলে লিচুর চাষ হয়। তবে বাণিজ্যিক চাষ গত কয়েকবছরে বেড়েছে।
“সোনারগাঁয়ের লিচু দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অন্তত একমাস আগে বাজারে আসে। এমনকি দিনাজপুরের লিচুও আরও কয়েকদিন পরে বাজারে আসবে। এসব কারণে সোনারগাঁয়ের আগামজাতের লিচুর কদর বেশি। বর্তমানে রাজধানীর কাওরানবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পাওয়া ৯০ শতাংশ লিচুই সোনারগাঁয়ে উৎপাদিত।”
এদিকে, এ বছর ফলন কম হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের কথা জানালেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “এই উপজেলায় অনেক বাগানমালিক আছেন যারা বাগান ভাড়া দিয়ে দেন। ভাড়াটে চাষিরা অনেক সময় গাছের সঠিক পরিচর্যা করেন না। এমনকি কৃষি কর্মকর্তাদেরও পরামর্শ নিতে আসেন না। তীব্র তাপদাহে নিয়মিত পানি ব্যবহার ও সেচের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া, লিচু পাড়ার পরও বাগানের পরিচর্যা করতে হয়, নাহলে পরের বছর ভালো ফলন পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে অনেকেই উদাসীন।”
তবে, নিজেদের সীমবদ্ধতার কথা জানিয়ে আফরোজা বলেন, “বাগান মালিক বা চাষিদের আমরা সবসময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি। চাহিদাভিত্তিক কীটনাশক ছেটানোর মেশিনও দিয়ে থাকি। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মেশিন নেই। এজন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চাহিদাপত্রও দেওয়া আছে।”