মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি আদমজীর ‘যমঘর’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলের বিহারি ক্যাম্প পরিচিত ছিল ‘যমঘর’ হিসেবে। পুরো নয় মাস সেখানে চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও ক্যাম্পের অবাঙালি বিহারিদের হত্যাকাণ্ড। স্বাধীনতার পরে এই বধ্যভূমিটির সন্ধান মেলে। তখন কয়েক হাজার নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে।
নারকীয় সেই স্মৃতি এখনও দগদগে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে। তারা বলছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা জুট মিলের পাম্প হাউজের ভেতরে নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন চালাতো। পরে তাদের গুলি করে হত্যার পর, করাত দিয়ে কেটে লাশের টুকরো অংশ ফেলতো ক্যাম্পের ভেতরের পুকুর ও পাশের শীতলক্ষ্যা নদীতে।
বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী পাটকলের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসমত আলী প্রধানের বাড়ি। তার স্মৃতিতে ভয়ঙ্কর সেই ‘যমঘরের’ বর্ণনা পাওয়া যায়। নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় হাসমত বলেন, “আদমজী পাটকলকে ঘিরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাস ছিল। শ্রমিক ছিল প্রায় ৬০ হাজার। চারপাশে ছিল শ্রমিকদের মেস। মেসের বড় বড় এক একটি ঘরে ৫০ থেকে ৬০ জন থাকতেন।
“মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই বিহারিদের সহযোগিতায় পাটকলটি আর্মিদের দখলে চলে যায়। সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার হাউজ, বার্মাশিল্ড, এসও এলাকায়ও ছিল আর্মি ক্যাম্প। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকরা যার যার বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু বিহারিরা মজুরির প্রলোভনে তাদের ডেকে এনে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।”
পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয়তার সাক্ষী আদমজীর ভেতরের বিহারি ক্যাম্পের বটগাছটি দেখিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরে ঢোকার একমাত্র গেটটি সবসময় বন্ধ থাকত। ভেতরের লোক ছাড়া ওই গেট খোলার অনুমতি ছিল না। মজুরি দেবে বলে সবাইকে দলবেঁধে এই বটগাছের নিচে দাঁড় করাত। তারপর গুলি করে মারত।
“বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে হত্যা করা হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলীকে আত্মসমর্পণ করার কথা বলে ডেকে এনে মারা হয় এখানে।”
১৯৭১ সালে স্থানীয় ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কর্মী ছিলেন গোদনাইল এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মোল্লা। সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দেয় তার। বলেন, “সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় তখন পরপর কয়েকটি আর্মি ক্যাম্প করে পাকিস্তানিরা। আদমজীতেও আর্মিদের একটি ক্যাম্প ছিল।
“ভয়ে লোকজন ওই রাস্তায় গিয়ে উঠতো না। যারেই সন্দেহ হতো তারেই যমঘরে নিয়া যাইত। সেখানে নির্যাতন করে তাদের লাশ দেয়ালের ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরে ফেলে দিত। আদমজী পাটকলে তখন সব জেলার মানুষ কাজ করত। অনেক শ্রমিকরেও কর্মরত অবস্থা থেকে ধইরা নিয়া নির্যাতন করে মারা হতো সেখানে। এই এলাকায় অন্তত হাজারখানেক মানুষ হবে, যাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারি ও পাকিস্তানি আর্মিরা মারছে।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা তাইজুল ইসলাম বলেন, “পাম্প ঘরের ভেতরে একটা ধারালো তলোয়ারের মতো লোহার পাত রাখা ছিল। ওইটার নিচে মাথা রাইখা কাইটা ফেলত। এইটার কারণে লোকজন ওইটারে কইতো যমঘর।”
নির্যাতনের লোমহর্ষক গল্পের একটি শোনা গেল তার কাছে। তাইজুল বলেন, “চাঁদপুরের দুইজন শ্রমিক আমাগো বাড়িতে ভাড়া থাকত। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় তাদের ধইরা নিয়া মাইরা ফেলছে ওই যমঘরে। তাগো লাশও আর পাওয়া যায় নাই। আশেপাশে সব খালি জায়গা আর ডোবা ছিল।
“দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওইসব জায়গায় অনেক মাথার খুলি আর হাড়গোড় পাওয়া গেছিল। পাকিস্তানিরা চইলা যাওয়ার পরেও লোকজন ভয়ে ওই এলাকা দিয়া হাঁটতো না।”
পরিবারের প্রবীণদের কাছ থেকে ভয়ঙ্কর এই ‘যমঘর’ এর গল্প শুনে বড় হয়েছেন অনেকে। তাদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা ও মাটিকাটার শ্রমিক আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই এই যমঘরের কথা শুনে আসছি। অনেক মানুষরে এইখানে মাইরা পরে নদীতে ভাসাইয়া দিত। যুদ্ধের পরে অনেক মাথার খুলি, হাড়গোড়ও পাওয়া গেছিল।”
আদমজীর এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান সাউদ বলেন, “নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় গণহত্যা আদমজীতে হয়েছিল। বিভীষিকার রাজত্ব ছিল এখানে। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। কিন্তু আদমজীর পুরোটাই ছিল আর্মিদের দখলে। স্বাধীনতার পর থেকেই শহীদদের স্মৃতিতে এটা সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছি।”