ডিআইটিতে রেলের জমিতে মসজিদ কমিটির অবৈধ মার্কেট

নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি এলাকায় রেলওয়ের খালি জমি দখল করে অবৈধভাবে দু’টি মার্কেট নির্মাণের কাজ চলছে। ডিআইটি রেলওয়ে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধানে এই মার্কেট দু’টি নির্মাণের কাজ চলমান৷
যদিও মসজিদ কমিটির লোকজনের দাবি, এই মার্কেটের মাধ্যমে পাওয়া টাকা মসজিদের উন্নয়নের স্বার্থে খরচ হবে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, মসজিদ কমিটির লোকজন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে অবৈধভাবে রেলের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণের কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অগ্রিম টাকা আদায় করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিআইটি মসজিদ ও সামনের জায়গুলো বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন। পাশের শেখ রাসেল পার্কও নির্মাণ করা হয়েছে এ জমির উপর। কয়েক বছর আগে রেলওয়ের এসব জমি উচ্ছেদ করে উন্মুক্ত করা হয়। উন্মুক্ত জমির মসজিদের সামনের অংশে পরবর্তীতে অস্থায়ী কিছু খাবার ও কাপড়-টুপি বিক্রির দোকান গড়ে ওঠে। এসব দোকান থেকে ভাড়াবাবদ টাকা আদায় করতো মসজিদ কমিটি। এবার মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধানে রেলের খালি জমিতে সেমিপাকা মার্কেট নির্মাণ করার কাজ চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায় মসজিদের সামনে খালি থাকা জমিতে দু’টি মার্কেট নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। দু’টো মার্কেটেরই দেয়াল তোলার কাজ শেষ। একটিতে উপরে টিনও লাগানো হয়েছে। কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা।
কথা হলে নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, গত দশদিন ধরে তারা মার্কেট নির্মাণের কাজ করছেন। কাজ প্রায় শেষের দিকে।
মসজিদের সামনে এক কাপড় বিক্রেতার সাথে কথা হয়। মসজিদের প্রবেশ পথের বা পাশে অস্থায়ী দোকানে ব্যবসা করতেন তিনি। অস্থায়ী দোকানগুলো এখন সেমিপাকা করা হচ্ছে। তারা ভাড়া দেন মসজিদ কমিটির লোকজনকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দোকানি বলেন, “দোকানভাড়ার টাকা মসজিদের কাজেই খরচ হয় বলে জানি। আমাদের ভাড়া দেওয়ার কথা আমরা দেই। এখন টাকা কারা কীভাবে খরচ করেন সেইটা মসজিদ কমিটির লোকজনই ভালো বলতে পারবেন।”
পাশের মার্কেটের এক দোকানি বলেন, “এগুলো ছিল খালি জায়গা। সরকারি জায়গায় সরকারিভাবে অনুমতি না নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে সেই টাকা মসজিদের উন্নয়নে খরচ করাটা কতটা যৌক্তিক সেইটা একটু ভাবা দরকার। মসজিদের উন্নয়ন প্রয়োজন আছে কিন্তু সেইটা অবৈধ পন্থার মধ্য দিয়ে কেন আসবে?”
স্থানীয়রা জানান, মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজী মো. নূরউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আব্দুল আউয়াল। নূরউদ্দিন নারায়ণগঞ্জ শহরে নাগরিক আন্দোলনেও সক্রিয় একজন ব্যক্তি। ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ নামে একটি নাগরিক সংগঠনেরও সভাপতি তিনি।
যোগাযোগ করা হলে তিনি জমিটি রেলওয়ের মালিকানাধীন বলে স্বীকার করেন। তবে, এখানে যেসব সেমিপাকা দোকান তোলা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তিস্বার্থে নয় বরং মসজিদের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার হবে বলে দাবি করেন তিনি।
“এখানে নতুনভাবে কোনো দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। এই দোকানগুলো ২০ থেকে ৩০ বছর ধরেই ছিল। মাঝখানে কিছু দোকান উচ্ছেদও হয়েছিল। তখন টিনের বেড়া ও টিনের চাল ছিল। দোকানিদের তাতে অসুবিধা হয় এবং মসজিদের সামনের রাস্তাটিও ছোট হয়ে গিয়েছিল বিধায় কিছু দোকান সেমিপাকা করে তৈরি করা হচ্ছে। এইসব দোকান থেকে ভাড়াবাবদ তোলা টাকা মসজিদের স্বার্থেই খরচ করা হবে”, বলেন নূরউদ্দিন।
সরকারি জমিতে অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে দোকান বা মার্কেট নির্মাণ করা যায় কিনা প্রশ্ন করলে তিনি তার যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “সরকারের জমি আর রাস্তা সবকিছুর মালিকই তো জনগণ। এইখানে তো ব্যক্তিস্বার্থে কিছু হচ্ছে না। মসজিদের স্বার্থে হচ্ছে। অন্যায় যদি করে থাকি, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।”
মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ‘অনেক আগে’ রেলের কাছে মার্কেট নির্মাণের আবেদন করেছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে, সে আবেদনে সাড়া মেলেনি।
এদিকে, মসজিদের সামনের দু’টো মার্কেটই নয়, মসজিদ থেকে দক্ষিণ দিকে কিছুটা এগোলেই রেলের খালি জমিতে একটি খাবার হোটেলও দেখা যায়। চারদিকে টিনের বেষ্টনি দিয়ে খাবার হোটেলটি মাসখানেক আগে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে। হোটেলটি চালান দিলীপ দাস নামে এক ব্যক্তি। কথা হলে তিনি নিজেকে বিএনপির কর্মী বলে পরিচয় দেন।
দিলীপ বলেন, “আশেপাশে অনেক শ্রমিক, রিকশাওয়ালা আছেন। তাদের দুপুরে খাওয়ার জায়গা থাকে না দেইখা হোটেলটা করছি মাসখানেক হইছে। জানি সরকারি জায়গা, সরকারি লোক ভাঙতে কইলে ভাইঙা দিমু।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ রাসেল পার্ক ও আশেপাশের রেলওয়ের জমি নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিতে কাজ করছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের কথাবার্তাও এগিয়েছে। তবে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সারাদেশে মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এতে ঝিমিয়ে পড়ে রেলওয়ে ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যকার সমঝোতার কার্যক্রম।
এদিকে, রেলওয়ের এই জমিতে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগের কথা জানতে পেরে কয়েকদিন আগে সেখানে গিয়েছিলেন সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা জায়গাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে মসজিদ কমিটির লোকজনের সাথেও কথা বলেন। খালি জমিতে মার্কেট নির্মাণে সিটি কর্পোরেশনের আপত্তি থাকলেও তাতে পাত্তা দেননি মসজিদ কমিটির লোকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “এই জমিটি সরাসরি এখনও আমাদের তত্ত্বাবধানে যেহেতু আসেনি সেই কারণে আমরা জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারছি না। কিন্তু জায়গাটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখারই পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু মসজিদ কমিটি আমাদের কোনো পাত্তা দেয়নি।”
যোগাযোগ করা হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকির হোসেন বলেন, “আমরা এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। জমিটি সরাসরি আমাদের না, রেলওয়ের। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আগামীকাল (বুধবার) এটা নিয়ে প্রশাসক স্যারের সাথে কথা বলবো। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যে নির্দেশনা দিবেন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, এক্ষেত্রে মূলত করণীয় রেলওয়ের।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের এক কানুনগো বলেন, “নারায়ণগঞ্জে অনেক জমিই বেদখল হয়ে আছে। আমরা একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও নামে-বেনামে প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই পুনরায় দখল করে ফেলেন। নতুন সরকার গঠনের পর সারাদেশে রেলের জমি উদ্ধারে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে।”
“ডিআইটি এলাকায় রাসেল পার্ক সংলগ্ন উন্মুক্ত কিছু জমি আমাদের আছে তা জানি। কিন্তু সে জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণের বিষয়টি জানতাম। এ বিষয়ে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”