রনজিত কুমার স্মরণে ‘দেশভাগ নদীভাগ ও নারায়ণগঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা
রনজিত কুমার স্মরণে শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমীর উদ্যোগে ‘দেশভাগ নদীভাগ ও নারায়ণগঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৫টায় আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন পরীক্ষণ হল (৫ তলা) এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমীর সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েলের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন। আলোচনা করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি প্রমুখ।
শেখ রোকন বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের মত এত বেশি আন্তঃসীমানা নদী বিশ্বে আর কোনো দেশে নেই। দাপ্তরিকভাবে বলা হয় ৫৪টি আন্তঃসীমানা নদী কিন্তু আমরা গবেষণা করে দেখেছি অন্তত ১২৩টি নদী আছে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় নদীকে সীমান্ত করে দুইপাড়ে দুই দেশ থাকে কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আড়াআড়িভাবে করা হলো যাতে গোড়ার গলদ থেকে যায়। যদি করিমগঞ্জ বাংলাদেশে হতো তাহলে সুরমা, কুশিয়ারি, টিপাই নিয়ে সমস্যা থাকতো না। যদি গোয়ালপাড়া বাংলাদেশে থাকতো তাহলে চায়না বা ভারত ডেম নিয়ে কথা বলছি ব্রহ্মপুত্র নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছি তা আর থাকতো না। মজার ব্যাপার হলো যে, মুর্শিদাবাদকে ৩দিন পর পাকিস্তানে রাখার পর ভারতকে দেয়া হল; ১৯৬০ সালে ফারাক্কাবাদ সেখানে তৈরি হল। যদি মুর্শিদাবাদ বাংলাদেশে থাকতো তাহলে ফারাক্কার প্রশ্নই আসতো না। নেহুরুর কথা মুর্শিদাবাদ ভারতকে দেয়া হলো কিন্তু আমাদের নেতারা তা ভাবলেনই না। ১৯৬০ সালে যখন ফারাক্কা তৈরি হচ্ছে তখনও আমাদের নেতারা কিছু বললেন না। তার মানে আমাদের নেতারা নদী নিয়ে আগেও ভাবেনি, পরেও ভাবেনি। দেশ ভাগের পরেও নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবেনি। আফসোসের বিষয় হল, দেশভাগের সাড়ে ৭ দশক পরেও নদী নিয়ে ভুগছি, আরও কতদিন ভুগতে হবে জানি না।
রফিউর রাব্বি বলেছেন, বিপ্লব ঘন্টা বাজিয়ে, ঘোষণা দিয়ে হয় না। প্রতিনিয়ত বিপ্লব হচ্ছে, এটি একটি ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়া। বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি করা হচ্ছে বিপ্লবীর কাজ। রনজিত এই ক্রিয়াকে উপলব্ধি করেছিলেন। সে চিকিৎসক, আন্দোলনকারী হতে চেয়েছিলেন শেষে সংস্কৃতি ও লেখালেখিতে স্থায়ী হয়েছে। আমি মনে করি এটিই তার উপযুক্ত জায়গা। শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিশুদের দিয়েই শুরু করতে হবে। পরবর্তীতে শ্রুতি, ধাবমান করেন।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে বেশকিছু সংগঠন রয়েছে যারা নিয়মিত সাংস্কৃতিক আয়োজন, সাহিত্যচর্চা, পাঠচক্র করছে। কিন্তু এর দৃশ্যমান পরিবর্তন কোথায়? একটি জেলায় এত সংগঠন থাকলে বদলে যাওয়ার কথা। তাহলে গলদ কোথায়? এটা বের করা উচিত।
রফিউর রাব্বি বলেন, শীতলক্ষ্যা নিয়ে অনেকে বিস্তারিত লিখেছে। তাদের লেখার সাথে আজকের শীতলক্ষ্যা মেলানো যাবে না। রুমান গর্ডেন তার 'দ্যা রিভারে' বলেছেন, শীতলক্ষ্যা নদী এক মাইল প্রসস্থ। এ অঞ্চল গড়ে উঠা, বেড়ে উঠা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবকিছু এই নদীকে কেন্দ্র করে। এই নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবন, জীবিকা কিন্তু আমরাই এই নদীকে ধ্বংস করে দিলাম। আমরা আমাদের নদীকে রক্ষা করতে পারিনি।
যখন আগ্রাসনের ক্ষমতা থাকেনা তখন ভদ্রলোক, যখন ক্ষমতা চলে আসে তখন আগ্রাসী। স্বৈরশাসনের লোকজন সরকার প্রশাসনের ছত্রছায়ায় নদী দখল করেছে। স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে এখন আর হবে না এটাও বলা যায় না। কারণ গত ৩ মাস আমরা দেখছি কিভাবে এই ক্ষেত্রগুলো দখল হল, কিভাবে আরেকটি মাফিয়া চক্র গড়ে উঠছে তাও আমরা দেখছি। আমাদের সহযোগী, সাংস্কৃতিক, সামাকিজ, নাগরিক সংগঠনের দায় আছে। বারবার মাফিয়া তৈরি হবে আর আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো এটা চলতে পারে না। এটা বদলাতে হবে। মাফিয়া গড়ে উঠার যে যন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন ছাড়া এ থেকে আমাদের স্থায়ী কোনো মুক্তি নাই।
মাহমুদুল হক বলেন, আমি নারায়ণগঞ্জে যুক্ত হওয়ার পর শীতলক্ষ্যা নিয়ে কাজ করবো। আমি পুরো নদী পরিদর্শন করে দেখলাম, অনেকগুলো ড্রেজার, পুরনো জাহাজ ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলোকে সরিয়ে নিতে আমি তখন সরকারকে চিঠি দেই। এরপর জিআইজেড নিয়ে ওয়ার্কশপ করেছি, ইটিপি নিয়ে কাজ করেছি। অধিক মুনাফার লোভে শিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহার করছে না। এই নদী যদি আগের রূপে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা এই নদী থেকে আয় করা যাবে সেটি ভুলে যাচ্ছি। শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত লোভে ডাইং এর রং নদীতে ছেড়ে দিচ্ছে। মুনাফার বেশি করার জন্য ইটিপি ব্যবহার করছে না। ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে গিয়ে বসে থাকতে পারে না। সকলকে সচেতন হতে হবে দায়িত্ব নিতে হবে।