এক সেতুর আশায় ২ দশক পার
ছয় বছরেও শুরু করা যায়নি কদমরসুল সেতুর কাজ
নারায়ণগঞ্জের বুক চিরে বয়ে চলা শীতলক্ষ্যা নদী জেলার গুরুত্বপূর্ণ দুই উপজেলা সদর ও বন্দরকে আলাদা করেছে। দুই উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের প্রতিদিনের যাতায়াত সহজ করতে একটি সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। দুই বছর আগে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর শীতলক্ষ্যার ওপর নির্মিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু সদর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করলেও শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের মানুষের নিত্যদিনের যাতায়াতে কোনো উপকারে আসেনি বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের কেন্দ্রস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর অবস্থান। ফলে জীবিকার তাগিদে যারা প্রতিনিয়ত নদী পারাপার করেন, এটি তাদের কোনো উপকারে আসে না।
অন্তত দুই দশক আগে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের মানুষের চলাচল সহজ করতে নবীগঞ্জ এলাকায় একটি সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর নবীগঞ্জ খেয়াঘাট এলাকায় সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর প্রায় অর্ধযুগ আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কদমরসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হলে আশায় বুক বাঁধেন দুই পারের মানুষ। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও সেতুর কাজ শুরু না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
২০১৮ সালে শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় ‘কদমরসুল সেতু’ নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে সেই কাজ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
সিটি করপোরেশন বলছে, শুরুতে ভূমি নিয়ে জটিলতা ছিল। এজন্য সেতুর নকশায়ও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সব জটিলতা মিটেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে বলে কর্মকর্তারা আশাবাদী।
এদিকে সেতুটি না হওয়াতে নিয়মিত নদী পার হওয়া নিয়ে ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলছে না দুইপাড়েরর বাসিন্দাদের।
পঁয়ষট্টি বছর বয়সী অটোরিকশা চালক জাহাঙ্গীর মৃধা থাকেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকায়। কয়েক মাস আগে রাত ২টার দিকে প্রতিবেশী এক নারীর প্রসব বেদনা উঠলে তার ডাক পড়ে। বন্দর উপজেলায় আধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাসপাতাল না থাকায় বাসিন্দাদের ভরসা করতে হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই সরকারি হাসপাতালের ওপর। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি। বন্দর থেকে সদরে পৌঁছাতে পার হতে হয় শীতলক্ষ্যা নদী। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় রাতের বেলা কেউ অসুস্থ হলে। কারণ রাত ১২টার পর ঘাটে ট্রলার থাকে না। প্রায় সময় নৌকা জোগাড় করাও মুশকিল হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর মৃধা সেই রাতে তার অটোরিকশায় করে প্রতিবেশী সেই প্রসূতি নারীকে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ঘাটে এসে দেখেন, কোনো ট্রলার বা নৌকা নেই। তখন কয়েক কিলোমিটার ঘুরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছাতে লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা।
জাহাঙ্গীর বলেন, “সেন্ট্রাল ঘাটের কাছাকাছি একটা সেতু থাকলে দুই মিনিটও লাগত না। এই রকম প্রায় সময়ই রোগীরা ঝামেলায় পড়েন।”
নারায়ণগঞ্জ জেলার দুই প্রান্তে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর দুটি সেতু থাকলেও মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করা মানুষের সেগুলো কাজে লাগছে না।
বন্দরের সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে মদনগঞ্জে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর দূরত্ব সড়ক পথে অন্তত তিন কিলোমিটার। সেতু পার হয়ে আবার সদরে মূল শহরে আসতে আসতে আরও তিন থেকে চার কিলোমিটার পথ পার হতে হয়। অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংযোগের জন্য তৈরি করা কাঁচপুর সেতুটি সেন্ট্রাল ঘাট থেকে অন্তত ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে। কিন্তু কদমরসুল সেতু বন্দর ও সদরের দুই শহরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করলে তা মাত্র দুই মিনিটের পথ হবে।
সেতু না হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজন ও পেশাগত তাগিদে দুই উপজেলার মানুষ প্রতিদিন চারটি খেয়াঘাট দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নৌকা, ট্রলারে নদী পার হচ্ছেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নদী পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
শীতলক্ষ্যার পাড়ের ৫৫ বছর বয়সী চায়ের দোকানি মো. কবির বলেন, “সেতু হইব, সেতু হইব- শুনতে শুনতে আমার চুল পাইকা গেছে। সেতু আর দেখি নাই। “যখনই নির্বাচন আসে, সবাই সেতুর কথা কয়, কই সেতু তো আর দেখি নাই। মদনগঞ্জে একটা সেতু হইছে তাতে আমাগো কী লাভ হইছে। ওই অত ঘুইরা নদী পার হইয়া তো লাভ নাই।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঙ্ক্ষিত সেতু না হওয়ায় দুর্ভোগ কমেনি তাদের। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় বন্দর উপজেলার বাসিন্দাদের। প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে নদী পেরিয়ে শহরে আসেন। শীতলক্ষ্যার মত ব্যস্ত নৌপথে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারই তাদের একমাত্র ভরসা।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম নিজেও বন্দর উপজেলার বাসিন্দা। তিনি বলেন, “কদমরসুল সেতুটি দৃশ্যমান হলে আসলে দুই শহরের মধ্যে সংযোগ ঘটাবে। এটা সত্য যে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পদ্মা সেতুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। কিন্তু নদীর দুই ধারের স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি সেতু দরকার, যা আসলে তাদের চলাচলের সুবিধা দেবে।”
সেই সেতুর কাজ এখনও শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে জহিরুল বলেন, “এ বিষয়ে সরকারি দপ্তরগুলোকে আরও আন্তরিক হতে হবে। তারা জনসাধারণের সেবা করার জন্য বেতন পায়, কিন্তু অনেক সময় তারা এমন প্রকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যা জনসাধারণের উপকার করে। তাছাড়া এই সেতু নির্মাণ না হওয়ার পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও দায়ী।”
দ্রুততার সঙ্গে কদমরসুল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করার আহ্বান জানান জহিরুল।
২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে ভোটারদের দুর্ভোগ দূর করতে শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন আইভী। ২০১৭ সালে শীতলক্ষ্যার উপরে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ ১ হাজার ৩৮৫ মিটার সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন।
সেতুটি শহরের ৫ নম্বর গুদারাঘাট এলাকার সঙ্গে অপর প্রান্তে বন্দর উপজেলার একরামপুর এলাকার সংযোগ করবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নয়টি ওয়ার্ড নদীর পূর্বপাড়ে কদমরসুল অঞ্চলে। সেতুটি মূল শহরের সঙ্গে এসব ওয়ার্ডের বন্দর, সোনাকান্দা, নবীগঞ্জ, ফরাজিকান্দা, শাহী মসজিদ, স্বল্পেরচকসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের যাতায়াত সহজ করবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতুটি কদমরসুল অঞ্চলের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে শহরের ৫ নম্বর ঘাট দিয়ে নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে এসে নবাব সিরাজউদৌল্লাহ সড়কে মিলিত হবে।
বন্দর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কদমরসুল দরগাহের নামে এ সেতুর নামকরণ করারও সিদ্ধান্ত হয়।
পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর একনেক সভায় এ প্রকল্পের জন্য ৫৯০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বরাদ্দ পায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
“কিন্তু প্রকল্পের শুরু থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাধা আসতে শুরু করে। এসব জটিলতা নিরসন করতে করতে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, এমনকি প্রকল্পের নকশাও পরিবর্তন করতে হয়”, বলেন সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল আজিজ।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, কদমরসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রকল্প এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিমপাড়ে রেলওয়ে ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআইডব্লিউটিএর জমি। আবার নদীর পূর্ব পাশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ নিয়েও জটিলতা দেখা দেয়। একইসঙ্গে বেসরকারি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের মালিকানাধীন জমির একটি অংশও প্রকল্পের জন্য বাধা ছিল। আপত্তি ছিল স্থানীয় নৌযান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদেরও।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৫ নম্বর ঘাট এলাকার কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, রেলওয়ের জমি এবং ৫ নম্বর ঘাটের পাশের খালে অংশ ব্যবহৃত হবে। শীতলক্ষ্যা পাড়ের জমিতে নিজস্ব টার্মিনাল করার পরিকল্পনা রয়েছে কুমুদিনীর৷ তারা রেলওয়ের থেকে লিজ নেওয়া তাদের জমি সেতুর জন্য ছাড়তে অসম্মতি জানায়।
এ ছাড়া নকশায় সেতুর একটি পিলার শীতলক্ষ্যার শাখা খালে পড়ায় পণ্যবাহী যান চলাচলে অসুবিধা হবে জানিয়ে আপত্তি তোলেন স্থানীয় নৌযান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
পরে কদমরসুল সেতুর নকশা পরিবর্তন করে কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নকশা তৈরি করা হয়। এরই মধ্যে রেলওয়ের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের জমি সংক্রান্ত চুক্তি সম্পন্ন হয়।
নতুন নকশা অনুযায়ী একরামপুরে মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্টের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণ করা এক একর জমি প্রয়োজন হয়। পরে সিটির ভেতরে সমপরিমাণ ভূমি দেওয়ার শর্তে জমিটি ছাড়তে রাজি হয় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তবে সিটির ভেতর এক একর খাস জমি পাওয়া মুশকিল হওয়াতে শুরুতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার দর কষাকষি হয়। শেষে তাদের শর্তেই রাজি হয় সিটি করপোরেশন।
এসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে প্রকল্পের ব্যয় ২৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকায়। মেয়াদ বাড়ার পর ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী আব্দুল আজিজ বলেন, “অনেক বাধা ছিল, সেসব দূর হয়েছে। চূড়ান্ত নকশারও অনুমোদন পাওয়া গেছে। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এরইমধ্যে দরপত্র আহ্বান করেছে। দরপত্র প্রদানের প্রক্রিয়াও শেষের দিকে।
এলজিইডি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসানুজ্জামান সম্প্রতি বলেন, “কনসালটেন্ট নিয়োগের পরও সেতুর কাজ শুরু করা যায়নি, নানা জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা একেবারে প্রান্তে চলে এসেছি। শিগগিরই টেন্ডারের কাজ শেষ হবে, চলতি বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু হবে।”