বিকেএমইএ: মনসুরের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার, চাপ নাকি সমঝোতা
দুইদিনের মাথায় পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ। সংগঠনের বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও পরিচালনা পর্ষদের একাধিক পরিচালককে ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী’ উল্লেখ করে পদত্যাগ করা এ ব্যবসায়ী নেতা তাঁর বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন ‘ইউটার্ন’ বিকেএমইএ’র সদস্য ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। মনসুর আহমেদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে ‘চাপ’ নাকি ‘সমঝোতা’ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে, সে গুঞ্জন চলছে।
মনসুর আহমেদ কি বর্তমান পরিচালনা পরিষদের সাথে ‘সমঝোতা’ করেছেন নাকি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে কোনো ‘চাপ’ কাজ করছে, সে গুঞ্জন চলছে। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে এখনো বিকেএমইএ’তে সাবেক সভাপতি সেলিম ওসমানের প্রভাব রয়েছে।
গত ২৮ নভেম্বর নির্বাহী সভাপতির বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন বিকেএমইএ’র শীর্ষ দুই নেতা। তাদের মধ্যে মনসুর আহমেদ বিকেএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং খুরশীদ আহমেদ তনিম পরিচালক পদে ছিলেন।
পদত্যাগপত্রে তারা বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর বা সহযোগী’ উল্লেখ করে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আচরণ এবং অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলেছেন।
তাদের অভিযোগ ছিল, ‘বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের নেতৃত্বে সংগঠনের মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তারা বলেন, "আমরা লক্ষ্য করেছি যে বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটছে যা আমাদের আমাদের সংগঠনের মূলনীতি- ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে লঙ্ঘন করছে।”
গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাতে সংগঠনের এ দুই পরিচালক বলেন, “বর্তমান সভাপতি এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”
শুধু পদত্যাগই নয়, এই দুই নেতা আগামী ৫ ডিসেম্বরে ডাকা সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ও বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাতিলের আহ্বান জানান।
তারা আরও বলেন, “মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং আমাদের বিবেকের তাড়নায়, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যারা এই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে, তাদের সঙ্গে আর কাজ করব না।”
বিকেএমইএ’র এই দুই নেতার আগে ব্যবসায়ী সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর’ উল্লেখ করে এক সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন।
গত ১ নভেম্বর বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায় এম ডব্লিউ স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণে মাদক-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস রোধে বিএনপির এক সমাবেশে গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘এই হাতেম স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর। তাঁর বক্তব্য, বিবৃতির সবকিছু আছে। তাকে দেখে এখন আপনারা বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যবসা দিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করছেন। মনে রাখবেন বিএনপির সবাইকে একসাথে করে ফেললেও গিয়াসউদ্দিনের মাথা গিলতে পারবেন না। আপনাদের ছাড় দেওয়া হবে না, অবিলম্বে এই কমিটি ভেঙে দিয়ে যারা ভালো নিরীহ তাদের দ্বারা কমিটি গঠন করতে হবে।’
বিকেএমইএ’র বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ থাকলে ‘বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে’ বলে মন্তব্য করে বিএনপির এ নেতা ‘দালালদের বিতাড়িত’ করার আহ্বান জানান।
গত ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে টানা দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দখল ছিল দলীয় সমর্থকদের কাছে। সরকার পতনের আগ পর্যন্ত টানা ১৪ বছর পর নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ গঠন করে সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন জাতীয় পার্টির এ নেতা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নারায়ণগঞ্জ শহরে আর দেখা যায়নি সেলিম ওসমানকে। অজ্ঞাত অবস্থান থেকে নিজের পদত্যাগপত্র বিকেএমইএ’তে পাঠান তিনি। পরে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে নির্বাহী সভাপতি থেকে সভাপতি হন মোহাম্মদ হাতেম।
ব্যবসায়িক সংগঠনটির একাধিক নেতা জানান, দীর্ঘদিন একক অধিপত্য বিস্তার করা সেলিম ওসমানের অনুসারীরা এখনও পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের ওইসব নেতাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতা করারও অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ‘দোসররা’ এখনও বিকেএমএইএ নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ একাধিক নেতার।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনসুর আহমেদের পদত্যাগের ঘোষণা ও দুইদিনের মাথায় আবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ব্যাপারটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিকেএমইএ’র সাধারণ সদস্যদের মধ্যে। চাপ নাকি সমঝোতার কারণে মনসুর আহমেদ পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ প্রশ্ন তাদের।
যদিও মনসুর আহমেদ তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদনে উল্লেখ করেছেন, তার পদত্যাগপত্রে বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও বোর্ডের কয়েকজন সদস্যকে ‘ফ্যাসিবাদী দোসর ও জুলাই-আগস্টের গণহত্যার সাথে জড়িত’ হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টি ‘একান্তই অনিচ্ছাকৃত ও অজান্তে’ হয়েছে।
তার দাবি, পদত্যাগপত্রে উল্লেখিত তথ্যগুলো ‘বাস্তবতা বিবর্জিত ও সম্পূর্ণরূপে ভুল’ ছিল বলে অনুধাবন করেছেন তিনি। তার পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তটিও নিট সেক্টর ও সংগঠনের স্বার্থের সাথে ‘সাংঘর্ষিক ও বিপরীতমুখী’ বলে উল্লেখ করে পদত্যাগপত্রটি প্রত্যাহারের আবেদন জানান।
এই বিষয়ে প্রেস নারায়ণগঞ্জের পক্ষ থেকে মনসুর আহমেদের সাথে যোগাযোগের জন্য তার মুঠোফোনের নম্বরে কল করা হলে তিনি কলটি কেটে দেন।
তবে, অপর একটি গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি দাবি করেছেন, ‘চাপের মুখে’ তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিলেন। পরে তা প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলে ওই গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছে।