মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “৫ আগস্টের পর আমরা অন্য রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছি। (শুরুর) ১৫-২০ দিন তো আমরা কোথাও আমরা ভিজিবল পুলিশ-ফোর্স দেখিনি। তখন মুসলমানরা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছি, নিজেরা নিজেদের মহল্লা পাহারা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এই উদাহরণ দিলাম এইটা বোঝানোর জন্য যে, এইটাই বাংলাদেশ, এইটাই বাংলাদেশের স্পিরিট।”
শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷
এর আগে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন৷ পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এ উপদেষ্টা৷
কারও ধর্মীয় পরিচয়কে বিবেচনায় না নিয়ে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়াবো, কার ধর্মীয় পরিচয় কী, সেইটার দিকে তাকাবো না। আমি মনে করি, আমাদের সরকারেরও একই ফিলোসফি। আমরা সব ধর্ম, বর্ণ, যার যা পরিচয়; এই পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে আলাদা করবো না।”
তিনি বলেন, “শিল্পকলা একাডেমীর গত তিনমাসের কর্মসূচি যদি আপনি দেখেন, দেখবেন যে, মাসে সারাদেশে ৪০ থেকে ৭০টি কালচারাল প্রোগ্রাম করছে। এগুলো করার পেছনে মূল কারণ, সারাদেশে সংস্কৃতির উৎসব ছড়িয়ে দেওয়া। এবং সেটা আমরা ছড়াতে পারছি বলে বিশ্বাস করছি। তারুণ্যের উৎসব নামে একটা প্রজেক্ট হচ্ছে, সেখানেও অনেক কালাচারাল প্রোগ্রাম হচ্ছে। ফলে কালচারাল প্রোগ্রামের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না, বরং বেড়েছে।”
তবে, কিছু ঘটনা যে ঘটেছে সে ব্যাপারে এড়িয়ে যাননি আলোচিত এ চলচ্চিত্র পরিচালক৷ তবে, এসব ঘটনাকে তিনি ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে দেখতে চান বলে জানান৷
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “তবে, বিচ্ছিন্ন দু-একটা ঘটনার কথা যে আপনি বলেছেন, সেইটা আমরা অস্বীকার করছি না। সেইসব ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের তরফ থেকে প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ও আরেকজন উপদেষ্টার বক্তৃতা শুনেছেন। বাংলাদেশ হচ্ছে বৈচিত্র্যের জায়গা। এই বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমরা সব কাজ করবো। এই বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন নির্দেশিত। আপনি নারায়ণগঞ্জের যে প্রসঙ্গের কথা বললেন সে বিষয়ে ডিসি ও এসপির সাথে ফলপ্রসূ আলাপ হয়েছে।”
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সামনে এগিয়ে যাওয়া যেকোন জাতির লক্ষ্য। কিন্তু সামনে এগিয়ে যেতে গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে- পেছনে কোন রাস্তাটা ফেলে এসেছে বা কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছে এ জাতি, সেদিকে নজর রাখা। এদিকে নজর রাখার কাজই হচ্ছে লোক ও কারুশিল্প মেলার কাজ। আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমাদের জার্নিটা কেমন ছিল সেইদিকে খেয়াল রাখা।
প্রতিবছরের মতো এবারও বড় আকারে মেলা ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে ফারুকী এই মেলার বিষয়ে প্রচার-প্রচারণায় নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান।
দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মেলা প্রাঙ্গণে আসতে যাতায়াত ব্যবস্থা যাতে আরও উন্নত হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান৷
ঐতিহাসিক পানাম নগরের সংরক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, “পানাম নগর নিয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে কথা হয়েছে। কেননা আমরা মনে করি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাইট। এর প্রিজারভেশন (সংরক্ষণ) আমরা কীভাবে করবো, রেনোভেশনের ফিলোসফি কেমন হবে, এসব ইস্যু আছে। আমরা চাই অরিজিনাল আদলটাকে ধ্বংস না করে সংরক্ষণ করতে।
পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা বলেন, “পাশের দেশে পালিয়ে থাকা ফ্যাসিস্ট মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করেছে৷ দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারনে কোন চক্রান্ত সফল হয়নি৷”
তিনি বলেন, “আমাদের ধর্ম আমাদের সংস্কৃতির অংশ না এটা বলে থেকে ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি সাংস্কৃতিক বিরোধ মেটাতে না পারি তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না।”
‘এখনো চক্রান্ত চলছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের আনাচে কানাচে বাউল শিল্পীরা আছেন। তাঁদের নিয়ে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা চলছে। আপনারা সবাই মিলে এই প্রোপাগান্ডা রুখে দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেন বাংলাদেশের মানুষ কেমন এবং ইসলাম কতটা সহনশীল।”
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব হেলালউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুুমদার ও সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী উৎসবে দেশের প্রখ্যাত দু’জন কারুশিল্পীকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মাননা ও তিনজন কারুশিল্পীকে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরষ্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়।
এবছর নকশিকাঁথা শিল্পের জন্য বেগম হোসনে আরা ও তামা-কাঁসা শিল্পের জন্য মানিক সরকার আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে তাঁদের প্রত্যেককে তিন লক্ষ টাকা ও দেড় ভরি ওজনের পদক দেয়া হয়।
এবছর শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরষ্কার ২০২৪ পেয়েছেন, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর কারুশিল্পী মিলঞ্চি সিং, চিত্রিত হাতি ঘোড়া কারুশিল্পী ধীরেন্দ্র সূত্রধর ও টেপা পুতুল কারুশিল্পী সুনীল পাল৷ পুরস্কার হিসেবে তাঁদের প্রত্যেককে একভরি ওজনের পদক ও এক লক্ষ টাকা করে দেয়া হয়েছে।