নারায়নগঞ্জে হকার সমস্যা ও করণীয়
নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে শহরের চাষাড়া হতে দুই নাম্বার গেট, কালীবাজার, মিশনপাড়া, মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন স্থানে হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসে আছেন হকারেরা। কেউবা নারীদের অলংকার, কেউবা বাচ্চা বুড়োদের জামা-কাপড় কেউবা জুতা, বেল্ট ইত্যাদি নিয়ে একটি চৌকি বা ভ্যানে করে ফুটপাত ও রাস্তার ধার দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা এদের ভেতরেই তুলনামুলক সিজনাল ব্যবসায়ী ,তারা তেরপল বিছিয়েই বসে গেছেন। এদের ডাকগুলোও আকর্ষনীয়, এই একদাম দেড়শ, লইয়া যান দেড়শ, বাইচ্ছা লন দেড়শ। নিন্ম ও নিন্মমধ্যম আয়ের মানুষের কাছে হকার এক ভরসার নাম।
এই হকারেরা সাধারনত নারায়ণগঞ্জ এর স্থায়ী বাসিন্দা নন, আর শহরের তো প্রশ্নই উঠে না। আমি বেশ কিছু হকারদের সাথে আলাপ করে জেনেছি অধিকাংশ মানুষের বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, চাদপুর, কুমিল্লা, ময়ময়নসিং, বরিশাল এসব এলাকায়। এদের অনেকের ঘর নদীতে গিলেছে, কারও জমিজমা হারিয়েছে, কেউবা চাকুরির অভাবে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। মাধ্যমিক – উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা হকারও রয়েছেন অনেক। মূলকথা এই অর্থনৈতিক মন্দার যুগে দুমুঠো খেয়েপরে বাচার জন্যেই এই পেশা।
এত এলাকার মানুষ এক স্থানে জমায়েত হবার ফলও ভোগ করতে হয় নগরবাসীদের । হকাররা এই শহরের কালচারের সাথে অভ্যস্থ নয়। ক্রেতাদের সাথে খারাপ ব্যবহার আর নারীদের সাথে তর্কাতর্কি নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া পথচারী নারী ও ছাত্রীদের লক্ষ করে ইশারায় অশালীন বাক্য ছুড়ে দেয়া। আর ভিড়ের মাঝে পকেটমারের কৃতকর্মের ঘটনাও প্রচুর।
এত হকারদের আনাগোনার ফসল হচ্ছে পুরো নারায়ণগঞ্জ এর প্রধান সড়কগুলোর পাশের ফুটপাত দখল, হাঁটার স্থান থাকেনা বিন্দু মাত্র। নিরুপায় হয়ে সাধারন মানুষ নেমে আসে রাস্তায়, ফলে জুড়ে শহরজুড়ে শুরু হয় তীব্র যানজট, বিকাল থেকে তা হয়ে ওঠে আরো অসহনীয়। হেটে যেঁতে যেখানে ১৫ মিনিট লাগে সেখানে রিকশায় লেগে যায় আধা ঘন্টা বা তারও বেশী। শহরের হাসপাতাল গুলোতে গমনরত রুগীদের ভোগান্তি উঠে চরমে।
নারায়ণগঞ্জে পন্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন গুলোর বিপুল সময় নস্ট হয় এদের জন্য। যানজটের জন্য বানিজ্যিক প্রতিষ্টান গুলো বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। মার্কেটের দোকানদারেরা সিটি কর্পোরেশনকে ট্যাক্স দিয়ে, দোকান ভাড়াদিয়ে সকল আইন মেনে তারা ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অবৈধ হকারদের জন্য। আর হকারেরা স্থানীয় নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়া কিছু চাঁদাবাজ দের মাসোয়ারা দিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের সাথে রয়েছে কিছু ধান্ধাবাজ নেতা, শ্রমিক নেতা, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মচারী।
সম্প্রতি ২৫ ডিসেম্বর সদর থানা ওসি প্রত্যাহারের পর প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়ে হকার উচ্ছেদ করে, এতে করে হকারদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্দোলনে গরম করে রেখেছে তারা। তাদের সহায়তা করে যাচ্ছে স্রোতে গা ভাসানো কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতারা। তবে দাবি খুবই পরিস্কার, হকারদের পুনর্বাসন ব্যাতিত উচ্ছেদ কোন সমাধান নয়। তারা মাদক ব্যবসা করেনি কিংবা অসামাজিক কাজও নয়। তাদের অবশ্যই পুনর্বাসন করে দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, ২০১১ সালে ,মেয়র আইভি তৎকালীন ৭০০+ হকারদের মিশনপাড়ায় স্থানান্তরিত করে হকার্স মার্কেট তৈরী করে দিয়েছিলেন, কিছুদিন বেশ ভালো চলল, বছর দুই না যেতেই আবার ফুটপাত সব হকারদের দখলে, অভিযোগ ও প্রমান আছে বহু হকার তাদের বরাদ্ধকৃত দোকান ভাড়া ও বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি কিছু বেকার যুবকদের হকারি পন্য দিয়ে মাসিক বেতন ভিত্তিতে চাকুরি খাটাচ্ছেন। পুরো ফুটপাতকে মাফিয়াতন্ত্রের নিয়ন্ত্রন কায়েম করতে চাচ্ছেন এরা। ফলে প্রশাসনের ক্ষোভ জমল, ক্ষোভ জমল সাধারন মানুষের। বর্তমানে পুরো নারায়ণগঞ্জে চার হাজারের অধিক হকার রয়েছে। তবে এই বিপুল সংখক হকারদের আন্দোলন নগরবাসীর কাছে অনেকটাই জনসমর্থন হারিয়েছে।
এখন সমাধান কি ?
সমাধানের জন্য প্রথমত সরকার কে উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মেয়র আইভি যেসব সমাধান দিয়েছেন তাও যথেষ্ট সমর্থনযোগ্য।
১/ হকারদের জন্য নতুন নির্দিষ্ট স্থান বা মাঠ বরাদ্ধ করা যেঁতে পারে।
২/ সাপ্তাহিক হাটের মত ১টি দিন তাদের শহরে সুযোগ দেয়া যেঁতে পারে।
৩/ঈদগা, বরফকল মাঠ, খানপুরে তাদের বসার ব্যবস্থা করা।
৪/ শিক্ষিত হকারদের কারিগরি শিক্ষা দিয়ে চাকুরির ব্যবস্থা করা।
৫/ পুনর্বাসনের পর নতুন করে যাতে হকার আর না বসতে পারে সেই দিকে প্রশাসনের নজর রাখা।
৬/ হকারদের মাঝে থেকে ফায়দা লুটেরাদের খুজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা।
পরিশেষে বলা যায়, হকাররা নগরবাসীর কাছে বিষফোঁড়া হয়ে উঠুক তা কখনোই কাম্য নয়। নগরের ফুটপাত থাকুক মুক্ত। নগরের পরিবেশ হোক আরো সুন্দর।
সাবিত আল হাসান