স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জে সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪ টায় নারায়ণগঞ্জ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের জেলা শাখা এ সমাবেশের আয়োজন করে। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সংগীত ও আলোচনা পর্ব।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি জাকির হোসেন। আলোচনা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্য দীনবন্ধু দাশ, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক এর কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবি রঘু অভিজিৎ রায়, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল কান্তি দাস, সমমনা'র সভাপতি সালাউদ্দিন আহম্মেদ, প্রগতি লেখক সংঘ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সহ-সভাপতি শ. ম. কামাল হোসেন ও জেলা কমিটির সদস্য দুলাল সাহা।
সাংস্কৃতিক সমাবেশে আলোচকগণ বলেন, আমাদের সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, আদিবাসীদের অধিকার আর কৃষক আন্দোলন, ৫২' র ভাষা আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৮-৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১' এর মুক্তিযুদ্ধ। ১৯২০ এর দশক থেকে ১৯৪০ এর দশক পর্যন্ত রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় দুনিয়া জুড়ে হিটলারের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রভাবও রয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে। গত দুইশ বছরে আমাদের অসংখ্য অধিকার আদায়ের লড়াই, বাঁচার লড়াই, ও মানব মুক্তির লড়াই ঘিরে গড়ে উঠেছে আমাদের সংস্কৃতি। ক্ষুদিরাম, ভগৎসিং, প্রীতিলতা ও মঙ্গল পান্ডেরা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। তে-ভাগা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, নীল চাষীদের আন্দোলনও তাই। ৫২' এর ভাষা আন্দোলন ছিল দীর্ঘকাল ধরে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। কত গান, কবিতা, নাটক, সিনেমায় উঠে এসেছে ৫২' এর ভাষা আন্দোলন তা গুনে শেষ করা যাবে না। ৬৯' এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে হাজারো গণসংগীত। গত ৫০ বছর ধরে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্যতম উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা ছিল আমাদের ছোটবেলার ভাবনা ও কল্পনার বিষয়বস্তু। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা সময় জুড়ে ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।
আলোচকগণ আরও বলেন, এতকিছুর পরে এসে আমরা আবার পিছনে ফিরে যাচ্ছি মনে হয়, অনেকটা অন্ধকারে। অনেকেই আমাদের এই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চায়। লৌকিক বাস্তব জীবন থেকে এক অলৌকিক অন্ধকার পথে যেন নিয়ে যেতে চায়। তাই বারে বারে গণতন্ত্র মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান মনস্কতার ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বাড়ছে, অর্থনীতির কেন্দ্রীভবন হচ্ছে, বাড়ছে পাহাড় সমান বৈষম্য। একটা লুটের গোষ্ঠী আর মাফিয়াতন্ত্রের যাতাকল থেকে মুক্তির আকাংখায় বারে বারে মৃত্যুর সামনে দাড়াচ্ছে দেশের মানুষ।
তারা বলেন, সংস্কৃতি কর্মীদের পক্ষ থেকে তাই বর্তমান সময়ে দাবি আসছে সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সকল নির্বতনমূলক আইন বাতিল করতে হবে। আইনের এই ধারায় গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি ও সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনৈতিকভাবে বাধাপ্রদান বন্ধ করতে হবে। যাত্রা গান, পালা গান, কবি গান, বাউল গান, গম্ভীরাসহ আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চায় বাধাপ্রদান বন্ধ করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পরিসেবা বিলের নামে শ্রমিক ধর্মঘটের অধিকার হরণের পায়তারা সহ জনস্বার্থবিরোধী যে কোন আইন প্রণয়নের অপতৎপরতা যা অব্যহত ছিল তা বন্ধ করতে হবে। সকল কল-কারখানায় অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সকল জেলায় বাজার সিন্ডিকেট উচ্ছেদ করতে হবে। ঘুষ দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ করতে হবে। মাতৃভাষা শিক্ষাসহ সার্বজনীন, একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। সকল জাতিসত্তার রাষ্ট্রীয় সামাজিক স্বীকৃতি, সুরক্ষা এবং তাদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি জাতিসত্তার উপর অব্যাহত নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী সকল কর্মক্ষম মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
আলোচকরা বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় ভাস্কর্য, মাজার, মসজিদ, মন্দির ভাঙ্গা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা হচ্ছে। স্কুল কলেজে শিক্ষকদের ওপর একতরফা হামলা করা হচ্ছে; অবিলম্বে এই হামলা বন্ধ করতে হবে। অতীতের মত ধর্ম অবমাননার মিথ্যা আভিযোগ তুলে কোথাও কোথাও মানুষ হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই জন মানুষ হত্যা করা হোল। পাহাড়ে আবারও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে তাদের উচ্ছেদের ষঢ়যন্ত্র চলছে। এই ধারা বন্ধ করতে হবে। এদের গ্রেফতার করতে হবে। একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির পক্ষ থেকে দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ঠের পায়তারাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাট, ঘাট, বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের খবর আসছে। কোথাও কোথাও বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে জাতীয় সম্পদ নষ্ঠ করা হচ্ছে। মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ওপর সকল ধরনের আক্রমন রুখে দাঁড়াতে হবে। সকল বাম ও প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মীদের দেশ ও মানুষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আলোচকরা আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী শত শত ছাত্র-জনতার রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে দেশের সকল প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মীরা একটা বৈষম্যহীন শোষনমুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্ন রক্ষা করতে হবে, এগিয়ে নিতে হবে। ছাত্র-জনতার সাথে একাত্ব হয়ে দেশের সংস্কৃতি কর্মীরাও একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার লড়াই চালিয়ে যাবে। গণততন্ত্র বিরোধী সকল ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।